ক্ষমাহীন ও নিদারুণ আত্মগ্লানি

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

ছোট্ট এক বাসায় দুই ঘরে সদ্য পিতৃহারা দুই নাবালক সন্তান। মা উঠেছেন লিভিং রুমে, সম্পূর্ণ কোয়ারেন্টিনে। বোনটির শরীর রোগে জর্জরিত, অন্তরে স্বামী হারানোর শোক। বাবা হারানোর শোকে উন্মাদনাগ্রস্ত দুই সন্তান আকুল চিৎকার করে কাঁদছে।

অলংকরণ :আরাফাত
অলংকরণ :আরাফাত

নিউইয়র্ক শহরের জ্যামাইকায় আজ প্রায় এক মাস হলো আমি গৃহবন্দী। করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা যেখানে পৃথিবীর যেকোনো জায়গার চেয়ে বেশি। যতই দিন যাচ্ছে, মৃতের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। আর এখন তার সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছে নতুন এক অনুভূতি—ভয়।

ভয়ে গা শিউরে উঠতে শুরু করল, যখন জানতে পারলাম হাসপাতালে আর জায়গা নেই। আপনি অসুস্থ হয়ে ৯১১–এ কল দিলে লোক আসবে বটে ইএমএস (ইমার্জেন্সি মেডিকেল সার্ভিসেস) থেকে। তবে ‘আপনি যথেষ্ট অসুস্থ নন’, এই বলে সটান প্রস্থান করবে। হাসপাতালগুলোও হয়ে উঠেছে যমপুরী। চিৎকার–চেঁচামেচি করে আপনি সেখানে পৌঁছাতে পারলেও শেষ গন্তব্য অনিশ্চিতঅবস্থাভেদে ৪ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত আপনাকে হাসপাতালে রাখা হবে। কোভিড–১৯–এ যদি আপনি আক্রান্ত না–ও হয়ে থাকেন, সেখানে গেলে হয়ে যাবে।

হাসপাতালে অক্কা পেলেও রক্ষা নেই। ফিউনারেল হোমের আনুষ্ঠানিকতা আর মৃতের সৎকারেও এখন বিস্তর জটিলতা ও বিঘ্ন। ঘনিষ্ঠজনের মরদেহও আপনাকে দেখতে দেবে কি না, দিলেও কবে কখন কতক্ষণ, তার ঠিকঠিকানা নেই। জানাজায় যেতে দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। নিজের বাড়িতে মারা গেলেও রক্ষা নেই। কারণ, ফিউনারেল হোমে উপচে পড়া লাশ। লাশের চেয়ে লোক কম। দীর্ঘ লাইন।

এই চূড়ান্ত ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে চলে গেল আমার ছোট বোনের স্বামী, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। আমি শুধু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, কী অপরিসীম দৃঢ় আমার ছোট বোনের মনোবল, কী অপরিমিত ওর প্রাণশক্তি। স্বামীর মৃত্যুর পর ২১টা দিন সে নিজে করোনাভাইরাসের প্রতিটি লক্ষণের সঙ্গে লড়াই করে করে মৃত্যু উপত্যকা অতিক্রম করেছে। সে যে কী নির্মম আর করুণ দৃশ্য!

ছোট্ট এক বাসায় দুই ঘরে সদ্য পিতৃহারা দুই নাবালক সন্তান। মা উঠেছেন লিভিং রুমে, সম্পূর্ণ কোয়ারেন্টিনে। বোনটির শরীর রোগে জর্জরিত, অন্তরে স্বামী হারানোর শোক। বাবা হারানোর শোকে উন্মাদনাগ্রস্ত দুই সন্তান আকুল চিৎকার করে কাঁদছে। মা হয়ে সান্ত্বনা দিতে কলিজার টুকরো দুটোকে সামান্য বুকেও জড়িয়ে ধরতে পারছে না। সন্তানদের ব্যথা সহ্য করা, স্বামীর মৃত্যুশোক পার হওয়া, ভাইরাসের সঙ্গে চিকিৎসাহীন লড়াইয়ে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা। সারাক্ষণই ওর আকুতি, ‘আমি কি বাঁচব? আমি তো বাঁচতে চাই। আমার সন্তান দুটোকে তো বাঁচাতে হবে।’ মনে শক্তি জোগানোর চেষ্টায় নিয়মিত ফোনে ফোনে কথা বলেছি ওর সঙ্গে। নিজ চোখে তখন দেখেছি তার সে কী ভয়াবহ যুদ্ধ!

ওর এই অবস্থা দেখে দেখে ভাবি, আমার যদি কিছু হয়, তাহলে আমার বাচ্চাদের কী হবে? কাকে নিয়ে ওরা বাঁচবে? একদিকে আমার বোনের করুণ আকুতি, আরেক দিকে পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার জন্য নিজের ঘরে আমার বন্দিত্ব। অদৃশ্য ঘাতকের ভয়ে পাশের গলিতে নিজের বোনের স্বামীর জানাজা ও দাফনে যেতে পারিনি। পারিনি বোন আর সন্তানদের কাছে টেনে সান্ত্বনা দিতে। নিজের অপারগ এই বন্দিত্বকে মনে হচ্ছে এক নিদারুণ আর নিষ্ঠুর নিষ্ক্রিয়তা। এক দমবন্ধ করা অপরাধবোধ আর ক্ষমাহীন আত্মগ্লানি প্রতি মুহূর্তে আমাকে দংশন করে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

এক সর্বগ্রাসী ভয় যেন তার মস্ত হাঁয়ের মধ্যে সব গিলে খেয়ে ফেলছে—আমাদের মানবিকতা, আমাদের সংবেদনশীলতা, আমাদের পরার্থপরতা। চারদিকে শুধু ভয় আর ভয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়, আত্মীয়স্বজন–বন্ধুদের জন্য ভয়, আর্থিক অনটনের ভয়, সমাজ–সংসারের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়। সবাই মিলে এই ভয়কে জয় করাটাই সামনের বড় পরীক্ষা। পরম শক্তিমান সে পরীক্ষায় আমাদের জয়যুক্ত করুন।