উন্নয়নের কারিগর লি কুয়ান

লি কুয়ান ইউ
লি কুয়ান ইউ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্র। নেই কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ। অথচ সেই নগররাষ্ট্রই কিনা এখন বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র।
সিঙ্গাপুরের কথা বলা হচ্ছে। উন্নয়নের এই আদর্শ রাষ্ট্রের কারিগর সদ্যপ্রয়াত লি কুয়ান ইউ।

বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ সোমবার ৯১ বছর বয়সে মারা গেছেন আধুনিক সিঙ্গাপুরের এই জনক। তাঁর মৃত্যুতে সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

লি কুয়ানের জন্ম ১৯২৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। সিঙ্গাপুরে জন্ম নেওয়া লি কুয়ান যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ থেকে আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেন। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত পিপলস অ্যাকশন পার্টির (পিএপি) সহপ্রতিষ্ঠাতা লি কুয়ান ৪০ বছর ধরে দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার পর ১৯৫৯ সালে স্বায়ত্তশাসিত সিঙ্গাপুরে পিএপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন লি কুয়ান।

৩১ বছর ধরে এই পদে ছিলেন। ১৯৯০ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়েন তিনি। এ সময় বিস্ময়করভাবে সিঙ্গাপুরকে বদলে দেন লি কুয়ান। অপরাধ ও দারিদ্র্যপীড়িত বন্দর-শহর থেকে সিঙ্গাপুরকে এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত করেন এই নেতা।

১৯৬৩ সালে মালয়েশিয়ার সঙ্গে যোগ দেয় সিঙ্গাপুর। কিন্তু আদর্শগত কারণে সেই মিলন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৬৫ সালে স্বাধীন হয় দেশটি।

সিঙ্গাপুরের সংস্কারে নতুন করে উদ্যোগ নেন লি কুয়ান। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন তিনি। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ঐক্য বজায় রাখতে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

সিঙ্গাপুরকে পরিচ্ছন্ন ও সবুজ রাষ্ট্রে পরিণত করতে উদ্যোগী হন লি কুয়ান। চুইংগাম ও দেয়াললিখন নিষিদ্ধ করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় পর্নোগ্রাফি। অপরাধ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন লি কুয়ান। তাঁর প্রচেষ্টাতেই সিঙ্গাপুর এখন বিশ্বের অন্যতম বাসযোগ্য শহর। দেশটি দুর্নীতির অভিশাপ থেকেও হয়েছে মুক্ত।

বাজারবান্ধব নীতির জন্য ব্যাপক প্রশংসা কুড়ান এই নেতা। প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও একটি রাষ্ট্র যে অর্থনৈতিকভাবে চূড়ান্ত সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে, তার উদাহরণ সৃষ্টি করেন লি কুয়ান। সরকারি ও বেসরকারি পুঁজিবাদের মিশ্রণে সিঙ্গাপুরকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের নিরাপদ তীর্থক্ষেত্রে পরিণত করেছেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বের ঝলকে বিশ্বের বুকে অর্থনৈতিক বিস্ময় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে আধুনিক সিঙ্গাপুর। এখন অনেক দেশের কাছেই লি কুয়ানের সিঙ্গাপুর উন্নয়নের এক আদর্শ রাষ্ট্র।

উন্নয়নের জন্য লি কুয়ান বিশ্বজুড়ে ব্যাপক খ্যাতি পেলেও মানবাধিকার প্রশ্নে দেশে-বিদেশে সমালোচিত হন। শক্ত হাতে দেশ শাসন করেন তিনি। বিরোধীদের ব্যাপারে তাঁর সহনশীলতা ছিল খুবই কম। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, গণবিক্ষোভ ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ব্যাপারে কঠোর ছিলেন তিনি। এ জন্য দেশের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের দোহাই দিতেন এই নেতা। তিনি অকপটে স্বীকার করেন, বিচার ছাড়াই তাঁর সরকার লোকজনদের বন্দী করে। কারণ, এটা করা না হলে দেশ ধ্বংস হবে।

গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার ব্যাপারে লি কুয়ান বলতেন, উন্নয়নের জন্য একটি রাষ্ট্রকে কিছু স্বাধীনতা ত্যাগ করতে হবে।

লি কুয়ানের বড় ছেলে লি সিয়েন লং এখন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী। আড়াই দশক আগে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়েন লি কুয়ান। কিন্তু দেশটির ক্ষমতাবলয়ে আমৃত্যু প্রভাবশালী ছিলেন তিনি। গত কয়েক বছর ধরে তাঁকে খুব কম দেখা গেছে। তবে তাঁর ছায়া ছিল সবখানে।