আলেপ্পো এখন 'নরক'

আলেপ্পো শহরের বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বাশার আল আসাদ সরকারের পরিচালিত গোলাবর্ষণে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটে। ৮ ফেব্রুয়ারি এমনই এক হামলায় আহত এক ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: এএফপি
আলেপ্পো শহরের বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বাশার আল আসাদ সরকারের পরিচালিত গোলাবর্ষণে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটে। ৮ ফেব্রুয়ারি এমনই এক হামলায় আহত এক ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: এএফপি

সন্ধ্যায় রাতের খাওয়া শেষ করে ঘরে বসে টেলিভিশনে খবর দেখছিলেন কৃষক মাহমুদ তুরকি। এমন সময় বিমান হামলা হলো তাঁর বাড়িতে। পুরোপুরি উল্টে গেল জীবন।

এ ধরনের ঘটনা সিরিয়ার আলেপ্পো প্রদেশে হরহামেশাই ঘটছে। শুধু তাই নয়, এরই মধ্যে দেশটির সরকার আলেপ্পোর বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অংশের সঙ্গে সব ধরনের ত্রাণ সহায়তা সরবরাহের রাস্তা কেটে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে খাদ্য, পানি ও আশ্রয়ের অভাবে খোলা আকাশের নিচে বাস করছে মানুষ। তাই আলেপ্পো এখন সেখানকার বাসিন্দাদের কাছে ‘নরক’।


জাতিসংঘের তথ্যমতে, সরকারের সেনা অভিযানে আলেপ্পো ছেড়ে পালিয়েছে ৩১ হাজারের বেশি মানুষ। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রস (আইসিআরসি) জানায়, চলমান এই সহিংসতায় প্রায় ৫০ হাজার লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়েছে। এদের বেশির ভাগই আলেপ্পো প্রদেশের বাসিন্দা। গোলাবর্ষণে শিকার হয়ে হাজার হাজার আহত মানুষ চিকিৎসা জন্য ভিড়ছে তুরস্কে।


৪৫ বছরের তুরকিকে মিনাই এলাকার ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করে তাঁর বন্ধুরা। গত শুক্রবার চিকিৎসার জন্য চলে আসেন তুরস্কের কিলিস শহরে। সেখানেই হাসপাতালের বিছানায় মাথায় সেলাই আর পুরো শরীরে জখমের কালো দাগ নিয়ে কাতরাচ্ছিলেন তিনি। বলেন, ‘বিমান হামলার ওই মুহূর্তের কথা...কেউ বর্ণনা করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘ওই সময় আমি জ্ঞান হারাই। সন্তানসহ আমার ওপর ছাদ ভেঙে পড়ল। মনে পড়ে, আমার স্ত্রী চিৎকার করে জানার চেষ্টা করছিল আমি বেঁচে আছি কি না।

তুরস্কে প্রবেশের অপেক্ষায় অনকুপিনার ফটকে সিরিয়ান শরণার্থীরা। ছবি: এএফপি
তুরস্কে প্রবেশের অপেক্ষায় অনকুপিনার ফটকে সিরিয়ান শরণার্থীরা। ছবি: এএফপি

আলেপ্পো প্রদেশে রাশিয়ার সহযোগিতায় চলতি মাসের শুরু থেকে নতুন করে ভয়াবহ সশস্ত্র হামলা চলছে। এত হাজারো মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। তাঁদেরই একজন মারিয়া গ্রামের আলা নাজার। আকাশ ছোড়া গোলায় কাঁধে আঘাত পেয়েছেন তিনি। চিকিৎসা নিচ্ছেন তুরস্কে। এএফপিকে তিনি বলেন, ‘এর তুলনা কেবল নরকের সঙ্গে চলে। দিনে চারবারের বেশি বোমা হামলা হয়।’


আলা নাজার বলেন, ‘আমার একটি বিড়ালছানা আছে। সে বিমানের শব্দ পেলেই দৌড়ে খাটের নিচে পালায়। আতঙ্কে পশুরই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে মানুষ কীভাবে সহ্য করবে?’


সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানায়, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আলেপ্পোতে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে ২৩ জন শিশুসহ ৫০৬ জন নিহত হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুই লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।


আলেপ্পো হচ্ছে সিরিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কেন্দ্র। এখানে রয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন স্থাপনা। ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে প্রদেশটি। এর পশ্চিম অংশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে, পূর্বাংশ বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলায় অনেক সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে।


প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অনুরোধে গত বছর থেকে ইসলামিক স্টেট ও অন্যান্য জিহাদি সংগঠনের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় বোমা হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। পশ্চিমা দেশগুলোর অভিযোগ, সিরিয়ার নিরীহ লোকজনের ওপর হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। বাশার আল আসাদের সরকার এর বিরোধিতা করছে। সিরিয়ার কর্মীরা বলেন, এসব হামলায় অনেক সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। মস্কো এটিকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছে।

সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের কিলিস শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে যুদ্ধ বিমান। ছবি: এএফপি
সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের কিলিস শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে যুদ্ধ বিমান। ছবি: এএফপি

সিরিয়া থেকে পালানো হাজার হাজার লোক তুরস্কের আনকাপিনার সীমান্ত পয়েন্টে যাওয়ার জন্য আব-আল-সালামা সীমান্ত ফটকে ভিড় করছেন। যদিও সীমান্ত ফটকটি বন্ধ রয়েছে।


তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতগলু বলেন, সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য নতুন আরেকটি শিবির খোলা হচ্ছে। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, কেউ কেউ তুরস্ককে বলে—তোমার সীমান্ত খুলে দাও। এই কথাটি আমার কাছে কপটতা মনে হয়। তারা রাশিয়াকে কিছু না বলে কেবল তুরস্ককেই বলে। তুরস্ক এরই মধ্যে ২৭ লাখ সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।


হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, যুদ্ধপ্রবণ এলাকায় লোকজনকে থাকতে বাধ্য করার অর্থ হলো, সেখানবার মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা হতাহত হওয়ার ঝুঁকির মুখে।


এক বিবৃতিতে আইসিআরসি বলেছে, ওই এলাকায় ত্রাণ সহায়তা পাঠানোর সব রাস্তা কেটে দিয়ে সেখানকার লোকজনকে ‘কঠিন চাপে’র মধ্যে রাখা হয়েছে। এতে সেখানকার মানবিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে।


যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার এই পরিস্থিতি সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সেখানকার লোকজন। আহত তরকি কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘এখানে কোনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নেই, জাতিসংঘ নেই, জেনেভা নেই। আর এনজিওগুলো হলো মিথ্যার আস্তানা। নিরাপত্তা পরিষদও মিথ্যা বলছে।’ এএফপি ও বিসিসি অবলম্বনে