এই আমি আর ভার্চ্যুয়াল আমি

একই মানুষের দুই রূপ দেখা যায় ভার্চু্যয়াল আর বাস্তব জগতে। মডেল: বাপ্পী। ছবি: অধুনা
একই মানুষের দুই রূপ দেখা যায় ভার্চু্যয়াল আর বাস্তব জগতে। মডেল: বাপ্পী। ছবি: অধুনা

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের বেলায় মানুষ বেশি সচেতন থাকার চেষ্টা করে। দেখা যায়, কারও সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলার সময় আমরা যা ইচ্ছা বলে দিতে পারি। কিন্তু ফেসবুক স্ট্যাটাসে কিংবা অন্য কারও পোস্টের মন্তব্যের জায়গায় তা করতে পারি না। আবার উল্টোটাও হতে পারে। বাস্তব জীবনের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল জগৎ তাই আলাদাই।
অনেকেই আছেন মুখচোরা স্বভাবের, যেমনটা হলেন নাহিয়ান (ছদ্মনাম)। সব সময় চুপচাপ থাকেন, বন্ধুদের আড্ডায় কোনো বিষয়ে কথা উঠলে নিজের মন্তব্য প্রকাশ করতেও তাঁর যেন কেমন লাগে! কিন্তু ফেসবুকে সেই সমস্যা নেই। কারও সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হয় না এখানে। নাহিয়ান এখানে যা খুশি বলতে পারেন, নিজের চিন্তাভাবনা, আশা-হতাশা, মন্তব্য প্রকাশ করতে পারেন। তাই মুখচোরা স্বভাবের নাহিয়ান ফেসবুকে বেশ নিয়মিত ও সরব। কিন্তু সামনাসামনি পুরো উল্টো স্বভাবের হওয়ার কারণে, তাঁর বন্ধুবান্ধব কেন জানি বাস্তব জীবনের নাহিয়ানের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল নাহিয়ানকে মেলাতে পারেন না। ঠিক তেমনি ভার্চ্যুয়াল জীবনে তাঁর পরিচিতরা সামনাসামনি তাঁর সাহচর্যে এলে অবাক হন। নাহিয়ান নিজেও বুঝতে পারেন, তিনি দুই জায়গায় দুই রকম।
অনেকেই বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটা নিজের পরিচিতির জন্য অনেক গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন। আবার অনেক সময় সামনাসামনি যে মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে খুব হাসিখুশি, কথায় কথায় রসিকতা করছেন, তিনি ফেসবুকে খুবই গম্ভীর। আবার উল্টোও যে দেখা যায় না, তা-ও নয়। বাস্তব জীবনে খুব গম্ভীর মানুষটা ভার্চ্যুয়াল জীবনে খুব রসিক। শেয়ার করছেন সব হাসির পোস্ট, লিখছেন মজার মজার কথা। সামনাসামনি যে মানুষটা খুব শান্তশিষ্ট, ফেসবুকে তাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব চঞ্চল। এভাবে ভার্চ্যুয়ালি আরও অনেক ক্ষেত্রেই আজকাল আমরা হয়ে গেছি আমাদের বাস্তব সত্তার চাইতে আলাদা। নিজেদের মাঝে মাঝে মেলাতে পারছি না নিজেরাই। আবার মাঝে মাঝে ভার্চ্যুয়াল আমির সঙ্গে বাস্তব আমি মিলেমিশে পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের আমিত্ব। আমাদের কি তাহলে উচিত দুই ‘আমি’কে আলাদা করে রাখা। নাকি দুটো মিলে যেই নতুন আমিটা খিচুড়ি পাকিয়ে গেল, সেই আমিটাই ঠিক? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা যত বেশি সময় কাটাচ্ছি, যত বেশি নিয়মিত হচ্ছি, এমন নানা ধরনের প্রশ্ন তত বেশি সামনে আসছে।
এই যে বাস্তব আমির সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল আমির পার্থক্যটা, তা কেন হয়? সাধারণত, আমরা সামনাসামনি কথা বলতে গেলে একসঙ্গে সর্বোচ্চ দু-চার-দশ জনের সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুলোতে আমাদের একটা পোস্ট কিংবা ছবি দেখতে পান আমাদের বন্ধুতালিকার সবাই। সংখ্যাটা পাঁচ শ থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার জনও হতে পারে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ও কাউন্সিলর অ্যানি বাড়ৈও তেমনটাই মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের আচরণ একেক জায়গায় একেক রকমই হয়। আপনি বন্ধুবান্ধব, পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলার সময় যেমন করে কথা বলেন, যেমন আচরণ করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তেমনটা না করাই স্বাভাবিক। আবার আমরা অনেকেই সামনাসামনি স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারি না সবার সঙ্গে। এটা আমাদের আচরণের প্যাসিভ দিক। দেখা যায়, ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক কিছু আমরা বলি বা করি, যা সামনাসামনি করতাম না।’
স্বাভাবিকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর বাস্তবে আমাদের আচরণের মাঝে পার্থক্য থাকে। কিন্তু সেই ব্যাপারটা যদি আমাদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড প্রমাণ করে, তাহলে অবশ্যই খারাপ। অ্যানি বাড়ৈর মতে, ‘আমাদের আচরণে স্থান-কাল-পাত্রবিশেষে একটু পার্থক্য থাকবেই, তবে এমন হওয়াটা কখনোই উচিত নয় যে আমরা দুই জায়গায় পুরো দুই রকম কথা বলছি। বাস্তব জগৎ, ভার্চ্যুয়াল জগৎ—কোথাও এই কপটতা গ্রহণযোগ্য নয়।’
আমরা এই বাস্তব ও ভার্চ্যুয়াল দুই আমির মাঝে কোনোটাকেই বাদ দিতে পারব না। এর মাঝে কোনটি ভালো, কোনটি খারাপ সেই বিচারে না গিয়ে, দুই জায়গায় সম্পূর্ণ আলাদা না হয়ে, আমাদের উচিত দুটো আমির মাঝে একটা সেতু তৈরি করা। আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন, যাঁদের বাস্তবে বন্ধুবান্ধব, কথা বলার মানুষ কম, তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটাকেই বেছে নিচ্ছেন নিজেকে প্রকাশ করতে। অন্য অনেক কারণেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেই নিজেকে প্রকাশের জন্য ব্যবহার করি আমরা। তবে দুই জায়গায় একদম দুই রকম না হয়ে আমাদের উচিত, বাস্তবে আমাদের আচার-আচরণ, কথাবার্তার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আচার-আচরণ, কথাবার্তার মাঝে একটা সমন্বয় তৈরি করে নেওয়া। তাহলেই এই দুই আমির ব্যাপারটা আর সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না।