বাবা সব সময় মায়ের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেন

মেহতাব খানম
মেহতাব খানম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.

সমস্যা

আমি স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। আমরা ছয় বোন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো। তবু আমার মা-বাবার মধ্যে ভালো বোঝাপড়া নেই। তাঁদের মধ্যে সব সময় ঝগড়া লেগে থাকে। বাবা সব সময় মায়ের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেন।

এ কারণে আত্মীয়স্বজন হেয় করে কথা বলে। আমার জীবনটা দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে যাচ্ছে। এ হতাশার দিকটা প্রকট হয়েছে স্নাতক ভর্তি পরীক্ষার পর থেকে। ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পারা, অন্যের কাছে দিন দিন হেনস্তা হওয়া, এই হেনস্তার জন্য দিন দিন আত্মবিশ্বাসের মাত্রা কমে যাচ্ছে। পরিবারের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিতে নিতে আমি নিজে আর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আমার সমস্যাগুলো কারও সঙ্গে শেয়ার করার মতো কেউ নেই। এসব কারণে অনেক সময় বাঁচতে ইচ্ছা করে না। বুঝতে পারছি না আমি কী করব।

নাম ও ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক

পরামর্শ

ছয় বোনের মধ্যে তোমার অবস্থান কত নম্বরে রয়েছে, তা লিখলে ভালো হতো। এমনকি হতে পারে তুমি শেষের দিকে জন্ম নিয়েছ এবং পরিবারের সদস্যদের প্রত্যাশা ছিল, একটি ছেলে সন্তান হবে?

অনেক সময় বড় হওয়ার সময়ে আমরা যদি শুনি, আমার জন্মটি পরিবারের মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি, তাহলে কারও ক্ষেত্রে শৈশব থেকেই আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধ কমে যেতে পারে। অনেক সময় আমরা অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যাই। এ ছাড়া মায়ের সঙ্গে বাবার আচরণ তোমার মধ্যে প্রতিনিয়ত প্রচণ্ড কষ্ট ও যন্ত্রণা তৈরি করছে।

বাবা-মায়ের ঝগড়াঝাঁটি হলে সন্তানদের মধ্যে এতটা নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়, যা বলে বোঝানো যায় না। এই মানসিক ক্ষতিগুলো অপূরণীয়। সারা জীবন আমাদের এই মানসিক চাপের বোঝাটি বয়ে বেড়াতে হতে পারে। মনটা খুব ছোট হয়ে যায় এবং অনেক সময় ভেতরে খুব জেদ ও রাগ তৈরি হয়। বাবার দ্বারা যখন মা নির্যাতিত হন, তখন বিশেষ করে মেয়ে সন্তানটির মধ্যে বিষণ্নতার সঙ্গে রাগ, ভয় ও মায়ের কষ্টের সঙ্গে একাত্মতাবোধও তৈরি হতে থাকে।

আমি তোমার অনুভূতির প্রতি পরিপূর্ণভাবে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। একই সঙ্গে তুমি ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পারার কারণেও অন্যের দ্বারা মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছ। স্নাতক পর্যায়ের পর কিন্তু তুমি সিদ্ধান্ত নিতে পারো নিজের পছন্দমতো কোনো একটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার ব্যাপারে। তবে পরিবারের অভ্যন্তরের পরিবেশ অনুকূল না থাকলে লেখাপড়ার মতো জটিল বিষয়ে মনঃসংযোগ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

এত প্রতিকূলতার মধ্যেও তুমি কিন্তু নিজেকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছ। অন্যদের কাছ থেকে আসা নেতিবাচক মন্তব্যগুলোকে যদি কিছুটা কম গুরুত্ব দিয়ে নিজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধটি বাড়াতে পারো, তাহলে ভালো হয়। তোমার যে দিকগুলো খুব সুন্দর, সেগুলো প্রতিদিন লিপিবদ্ধ করতে থাকো। ছোটখাটো সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে সেটি বাস্তবায়ন করো। যেমন প্রতিদিন কোনো একটি সময়ে নিজেকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে একটি নোট বইয়ে কোনো ঘটনার দ্বারা তুমি কীভাবে কষ্ট পেয়েছিলে এবং কী ভেবে কষ্ট বা রাগ হয়েছিল, তা লিখে রাখো। যদি দেখো তুমি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেটি করতে পেরেছ, তাহলে নিজেকে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ দিয়ো।

এভাবে প্রায় প্রতিদিন এটি লেখা এবং অন্য কাজগুলো সময়মতো করতে পারলে আত্মবিশ্বাস বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তবে এই লেখাগুলো যাতে অন্য কেউ পড়তে না পারে, সেটি খেয়াল করো। যেহেতু কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারছ না, তাই কষ্টের কথাগুলো লিখলে ভেতরটা কিছুটা হলেও হালকা হবে। এ ছাড়া তুমি ০৯১৬২২২২৩৩৩-এই টেলিকাউন্সেলিং নম্বরে ফোন করে সেবা গ্রহণ করতে পারো।