কেন গভীরে যাই না

ওপর থেকে দ্রুত শুধু দেখে গেলেই হয় না, বিষয়ের গভীরে ঢোকা দরকার। মডেল: সাদিয়া। ছবি: সুমন ইউসুফ
ওপর থেকে দ্রুত শুধু দেখে গেলেই হয় না, বিষয়ের গভীরে ঢোকা দরকার। মডেল: সাদিয়া। ছবি: সুমন ইউসুফ

শরীফুন্নাহার (ছদ্মনাম) একজন শিক্ষক। কলেজে ভালোই পড়ান। সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি আছে। ভালো বলেন, মানুষ তাঁর কথাগুলো মন দিয়েই শোনেন। কিন্তু সমালোচকেরা বলেন তিনি নাকি খুব অল্প জেনে কথা বলেন, কোনো বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করেন না। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। সংসার, কর্মস্থল, বিশ্বাস আর বোধের জায়গাগুলো তার অনেকটাই নড়বড়ে। তাই দেখা যায় একজন ভালো বলিয়ে, লিখিয়ে হয়েও তিনি আত্মব্যক্তিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে খুব একটা পারদর্শী নন।

শরীফুন্নাহারের মতো অনেকেই আছেন যাঁরা কোনো বিষয়ের খুব ভেতরে প্রবেশ করতে চান না। অনেকটা নৈর্ব্যক্তিকভাবে যেনতেন প্রকারে একটি বিষয়কে বিচার-বিশ্লেষণ করেন। জীবনবোধের বিষয়গুলো তাঁদের কাছে কেবল উপরিতলেই থেকে যায়। এটি মূলত তাঁদের ব্যক্তিত্বের একটি প্রকরণ। সেই সঙ্গে ডিফেন্স মেকানিজমের কারণে নিজের ইগো বা অহংকে রক্ষা করতে গিয়ে তাঁরা এটি করেন। এ ধরনের উপরিতলের মানসিক প্রক্রিয়ায় যারা অভ্যস্ত তাদের বলা হয় ‘শ্যালো পিপল’। তারা সহজেই অপরের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে ফেলতে পারে আবার সম্পর্ক ভেঙে ফেলতেও তাদের সময় লাগে না। তাদের নিজের সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকে না, অনেক সময় নিজের সক্ষমতা আর দুর্বলতাগুলো তারা বুঝতে পারে না।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে সবাই খুব গভীর চিন্তার অধিকারী হবেন? সবাইকে কি জ্ঞানী হতে হবে নাকি? না বিষয়টা মোটেও তা না, প্রত্যেকের নিজস্ব ধারণার জগৎ রয়েছে, রয়েছে আলাদা বিশ্বাস আর মূল্যবোধ। এই বিশ্বাস যার যে রকমই হোক না কেন তা যেন যথেষ্ট দৃঢ় হয়, তার বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে তিনি যেন পারঙ্গম হন আর ছোটখাটো সমস্যাকে তিনি যেন রক্ষা এড়িয়ে না যান।

যাদের ‘শ্যালো পিপল’ বলা হয় তারা কারও বাহ্যিক দিকটা দেখে তার সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে নেয়। অপর দিকে যারা গভীর চিন্তা করে তারা ভেতরের মানুষকে খুঁজে নেয়। যারা গভীরভাবে ভাবতে চায় না তারা সাধারণত সবকিছু সরলরৈখিকভাবে দেখে, যা শোনে, যা দেখে তাই বিশ্বাস করে, যাচাই করতে চায় না। তারা মূলত সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে চলতে চায়। কখনো তারা কথা একটু বেশি বলে, ভেবেচিন্তে বলে না, মনে যা আসে তাই বলতে থাকে, ফলে অনেক সময় তারা সামাজিক সমস্যা তৈরি করে। আর গভীরভাবে যারা চিন্তা করে তারা ভেবেচিন্তে, বুঝেশুনে বলে। যারা গভীর চিন্তা করতে পারে না তারা মনে করে যেকোনোভাবে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করাই যথেষ্ট। খুব তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ তারা করতে চায় না। দৈনন্দিন কাজ এবং নিজের আবেগ-অনুভূতির বিষয়েও তারা অগভীর থাকে।

কেন মানুষ গভীরভাবে ভাবতে পারে না? এককথায় এর উত্তর হচ্ছে—প্রণোদনার (মোটিভেশন) অভাব। প্রণোদনা প্রক্রিয়ার শুরুতে থাকে আকাঙ্ক্ষা, যা চাহিদা আর আগ্রহের মাধ্যমে তৈরি হয়। এখন কারও যদি জীবনবোধ থেকে শুরু করে আটপৌরে কোনো বিষয়ে আগ্রহ কম থাকে, তখন তার মধ্যে কোনো চাহিদা তৈরি হবে না। চাহিদা না থাকার কারণে তার মধ্যে আকাঙ্ক্ষারও সৃষ্টি হবে না। আর আকাঙ্ক্ষা না থাকলে সে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে তার যাত্রা শুরু হবে না। এই নির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকায় সে বিক্ষিপ্ত ও অগভীরভাবে চিন্তা করবে। এ তো গেল তার অন্তর্গত ভাবনার দিক। আবার বহির্জগৎও তাকে অনেক সময় গভীর চিন্তা করতে দেয় না। বিশেষত ‘অবজারভেশনাল লার্নিং’ বা দেখে শেখার চর্চা বেশি চলতে থাকলে সে চিন্তা করতে চায় না। সে দেখে তার চারপাশের সবকিছু এভাবে হচ্ছে, ওভাবে হচ্ছে—তখন সে কেন হচ্ছে বা কীভাবে হচ্ছে সেই চিন্তার ধার ধারে না। সরাসরি কপি-পেস্টের পথ বেছে নেয়। কপি-পেস্ট করতে চিন্তা করতে হয় না। চারপাশের নানা উদাহরণ তাকে ভাবতে বাধ্য করে যে জীবনটা ভোগবাদী, এখানে গভীর জীবনবোধের ভাবনা কেবলই সময়ক্ষেপণ তাই হালকা ভাবনায় ডুবে তাৎক্ষণিক সমাধান পাওয়াটাই শ্রেয়।

এর পাশাপাশি আরেকটি বিষয় হচ্ছে শিশুদের মনঃসামাজিক বিকাশের পর্যায়গুলো—যেমন কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট (জ্ঞানীয়/ধারণার জগতের বিকাশ) বা মরাল ডেভেলপমেন্ট (নৈতিকতার বিকাশ)-এর সময় বাবা-মা বা আশপাশের পরিবেশ তাদের বিকাশের সুষম ধারাকে বিপথে পরিচালিত করে। শিশুর সামনে বড় কোনো স্বপ্ন বাবা-মায়েরা লক্ষ্য হিসেবে রাখেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র বৈষয়িক সাফল্যকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেন বলে শিশু প্রথম দিকে মনে করে পরীক্ষায় ভালো ফল করাটাই জীবনের লক্ষ্য। এরপর সে মনে করে বৈষয়িক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই জীবনের পরম আরাধ্য।

বাবা-মায়েরা এই ভাবনাগুলো তার মাথায় দারুণভাবে প্রোথিত করে দেন। ফলে শিশু তার চিন্তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারে না। চিন্তার প্রাবল্য, ব্যাপ্তি আর গভীরতা ক্রমেই কমতে থাকে। পরিণত বয়সেও সে অগভীর চিন্তার মধ্য দিয়ে নিজেকে চালিত করে। এই সব কারণে ‘শ্যালো পিপল’-এর আধিক্য বাড়ছে আর সেই সঙ্গে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে জীবনবোধের সংজ্ঞা। অগভীরতাই হয়ে উঠছে জীবনবোধের বৈশিষ্ট্য।

পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যখন কেউ এই অগভীরতার চর্চা করতে থাকে তখন সম্পর্কের অবনতি ঘটে, আর যেহেতু সম্পর্কটি অগভীর ছিল তাই সম্পর্কেও বিচ্ছিন্নতায় তারা খুব বেশি বিচলিত বোধ করে না। পেশাগত জীবনে যাঁরা গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে পারেন না তাঁরা তাৎক্ষণিক আর চমকযুক্ত সাফল্য পেলেও সেই সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী বা নন্দিত হয় না। চিন্তার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘চিন্তা করে করেই আমরা চারপাশের পৃথিবীকে গড়েছি, আর এই পৃথিবীর যেকোনো পরিবর্তনের জন্য চিন্তা করার বিকল্প নেই।’ তাই নিজেকেসহ চারপাশের যেকোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য চিন্তা মুক্তি বাড়াতে হবে। বোধ আর বিষয়ের গভীরে যেতেই হবে।

সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে, সম্পর্কের গুণগত মানকে উন্নত করতে আর পেশাগত জীবনে সত্যিকারের সফল হতে হলে অগভীর চিন্তার জগৎ থেকে বের হয়ে আসতেই হবে। জীবনবোধের ভাবনাটিকে করতে হবে তীক্ষ্ণ আর গভীর। কোনো কিছুকেই হালকাভাবে নেওয়া চলবে না।

সহযোগী অধ্যাপক

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।