নতুন বছরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা

গত বছর যাঁরা রোগ-শোকে ভুগেছেন, অসুখে-বিসুখে কষ্ট পেয়েছেন; নতুন বছরে তাঁদের সব দুঃখ, সব অসুখ ধুয়েমুছে যাক। তেমনি পুরোনো বছরে যাঁরা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারেননি, যাঁরা ছাড়তে পারেননি ধূমপান বা অন্যান্য বদভ্যাস—নতুন বছরে নিশ্চয়ই পারবেন।

এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র রায় বলেন, আর যাঁদের বয়স ৪০ পেরোল, তাঁদেরও উচিত নিজের শরীরের দিকে নজর দেওয়া। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো। এই বয়সে কোনো রোগ শরীরে বাসা বাঁধার আগেই তাকে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি থাকা দরকার। আপনার অজান্তে কোনো রোগ শরীরে কাজ শুরু করলে পরে তা জটিল হয়ে ওঠে। নানা রকম পরীক্ষা করে প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়া রোগ সহজেই নিরাময় করা যায়। তাই ভালো থাকার জন্য কিছু জরুরি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নিশ্চিত থাকা ভালো।

রক্তের শর্করা

রক্তের শর্করার পরিমাণ বাড়লে ডায়াবেটিস হয়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক, কিডনির জটিলতা, অন্ধত্বসহ নানা ধরনের জটিলতার জন্য দায়ী। প্রাথমিক অবস্থায় ডায়াবেটিস শনাক্ত ও জটিলতা এড়াতে চল্লিশের পর সবার উচিত রক্তের শর্করা বা গ্লুকোজের মাত্রা পরিমাপ করা।

লিপিড প্রোফাইল

উচ্চমাত্রার ক্ষতিকর কোলেস্টেরল ধমনির গায়ে জমে হৃদ্‌রোগ আর স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই বয়স ৩৫-এর বেশি হলে বছরে অন্তত একবার লিপিড প্রোফাইল করতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকলে বা এগুলোর পারিবারিক ইতিহাস থাকলে তা আরও নিয়মিত করতে হবে।

উচ্চ রক্তচাপ

উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে যেকোনো বয়সেই। তবে চল্লিশের পর আশঙ্কা বেশি। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হার্ট ফেইলিওর, স্ট্রোক, কিডনি জটিলতা হতে পারে। তাই সুস্থ থাকতে নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করতে হবে।

চক্ষু পরীক্ষা

চল্লিশের পর সাধারণত দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে। পড়তে শুরু করে চোখের ছানি। গ্লুকোমা হলে চোখের অপটিক নার্ভ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে দৃষ্টিহীনতা দেখা দেয়। তাই চল্লিশের পর অবশ্যই বছরে একবার চক্ষু পরীক্ষা করা জরুরি।

ক্যানসার স্ক্রিনিং

ক্যানসারজনিত মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ কোলোরেক্টাল ক্যানসার। উপসর্গবিহীন এই রোগ একেবারে শেষ পর্যায়ে ধরা পড়ে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শে এ বিষয়ে পরীক্ষা করতে হবে। তা ছাড়া চল্লিশের পর প্রত্যেক পুরুষের প্রোস্টেট ক্যানসার এবং নারীদের জরায়ু মুখের ক্যানসারের পরীক্ষা করাতে হবে।

হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা

হাড়ের ঘনত্ব কমে গিয়ে অস্টিওপোরেসিস হলে হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। বয়স চল্লিশ পার হলে এই রোগের ঝুঁকি বাড়ে। তাই হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা করাতে হবে।

স্থূল বা শরীরের অতিরিক্ত ওজন যাদের

অতিরিক্ত ওজন থাকলেও অনেকেই স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। হঠাৎ করেই তাঁরা বড় সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন। তাঁদের নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা প্রয়োজন। আরও কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে এ ধরনের মানুষের হঠাৎ আসা কোনো স্বাস্থ্যগত বিপদ নির্ণয় করা সম্ভব, যা তাঁদের জীবন বাঁচাতে পারে।

নারীর স্বাস্থ্য

ঘরকন্না থেকে শুরু করে সবকিছুতেই নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। ফলে ঘরে হোক কি বাইরে, সব জায়গাতেই নারীদের ওপর ক্রমাগত বেড়ে চলা কাজের চাপে তাঁদের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে ভুলে যেন না যান। বিশেষ করে, ৩০ বছর বয়সের বেশি হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত। কারণ, এ সময়টাতেই তাঁরা সবচেয়ে মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। আগেভাগেই যদি সতর্ক হওয়া যায়, তাহলে অর্থ, সময় ও শক্তির অপচয় হবে না।

. প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট

সার্ভিক্যাল ক্যানসার বা জরায়ু মুখের ক্যানসার শনাক্ত করার জন্য এই টেস্ট করানো হয়। মূলত ২১ বছর হওয়ার পর এই পরীক্ষা করানো দরকার। আর প্রতি তিন বছর পরপর এই পরীক্ষা করাতে হবে। নারীদের অকালমৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ এই ক্যানসার।

. ম্যামোগ্রাম

এই পরীক্ষা করানো হয় স্তন ক্যানসার শনাক্ত করার জন্য। ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারীদের প্রতি দুই থেকে তিন বছর পরপর এই পরীক্ষা করানো উচিত।

. থাইরয়েড টেস্ট

এই পরীক্ষা করালে থাইরয়েড উদ্দীপক হরমোন (টিএসএইচ) নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। টিএসএইচ বেশি হওয়াটা হাইপোথাইরয়েডিজম আর কম হওয়াটা হাইপারথাইরয়েডিজমের লক্ষণ। টিএসএইচের মাত্রা কম হলে ওজন বাড়া, ক্লান্তি ও অবসাদ, ত্বকের শুষ্কতা এবং নখের ভঙ্গুরতার মতো সমস্যা দেখা দেয়। আর কম হলে অনিদ্রা ও ওজন কমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়।

রক্তচাপ, কোলেস্টেরল স্ক্রিনিং, রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা অন্যদের মতোই করানো উচিত।

বয়স্ক ব্যক্তিদের চেকআপ

বয়স বাড়লে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি এমনিতেই বেড়ে যায়। আর এসব রোগের ঝুঁকি থেকে বাঁচতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এ পরীক্ষা শুরু করা প্রয়োজন ৪০ বছর বয়স থেকেই। ৬০ বছর বয়স পার হলে বিভিন্ন রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। তাই এ বয়সে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। ৫০ বছর বয়স পার হলে কলোরেক্টাল ক্যানসারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার পরীক্ষা করা উচিত।

নিশ্চিত করি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা

আসুন, নতুন বছরে আমরা অস্বাস্থ্যকর জীবনাচার বর্জন করি, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হই। প্রথমত, ধূমপান পুরোপুরিভাবে বর্জন করুন। আর একটিও সিগারেট নয়—নতুন বছরে এই হোক ধূমপায়ীদের শপথ। দ্বিতীয়ত, আসুন, বর্জন করি অতিরিক্ত তেল-চর্বি, লাল মাংস, মাখন-ঘি, চকলেট-ফাস্টফুড ও কোমল পানীয়। রসনাকে সংযত করি আর স্বাস্থ্যকর খাবার খাই। খাদ্যতালিকায় বেছে নিই সবুজ শাকসবজি, সালাদ ও ফলমূল। আসুন, অভ্যাস পরিবর্তন করি।

শিশুদের রাতে শোয়ার আগে কোমল পানীয় বা চকলেট নয়, খেতে দিন এক গ্লাস দুধ।

আসুন, এবার অলস জীবনযাপন ছেড়ে কায়িক শ্রমে উদ্বুদ্ধ হই।

লেখক: চিকিৎসক