চলতি পথে মন পড়ে রয়
রাজা মুকুট রায়ের রাজত্ব। বেশ প্রতাপশালী ছিলেন তিনি। প্রজাদের জলকষ্ট দূর করার জন্য খননকাজ শুরু করলেন। যত নিচ পর্যন্ত ঢোলের শব্দ শোনা যায়, ততই গভীর করা হয়েছিল এই দিঘি। বলছিলাম ঢোলসমুদ্র দিঘির কথা। গত ২০ নভেম্বর ঝিনাইদহের এই বিশাল দিঘি মুগ্ধ করল আমাদের। মৃদু বাতাস বইছে। আমরা চারজন মেয়ে দিঘির সামনে দাঁড়ানো। একটু আনমনা হয়ে গেলাম। চোখের সামনেই যেন খননকাজ চলছে। শুনতে পাচ্ছি ঢোলের শব্দ!
ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছি ১৮ নভেম্বর। দুটি স্কুটি নিয়ে ঘুরছি চারজন মেয়ে। ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাগুরা হয়ে ঝিনাইদহ। এবার আমাদের গন্তব্য চুয়াডাঙ্গা। বুঝতে পারিনি, দর্শনার কেরু অ্যান্ড কোং দেখেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। সে যাক গে, আমাদের পৌঁছাতে হবে মুজিবনগর। স্কুটি চালু করলাম। গতি ৬০ কিলোমিটার ঘণ্টায়। রাস্তা পুরোই অন্ধকার। শীতে কাঁপছি। কিন্তু শক্ত করে স্টিয়ারিং ধরা। শুনেছি, চুয়াডাঙ্গার রাস্তায় ডাকাত থাকে রাতে। পরিবেশও ছমছমে। কোনো আলোই নেই। হেডলাইটের আলোতেই দেখছিলাম সারি সারি গাছ। মোড়গুলোতে কিছু দোকানে লণ্ঠনের আলো টিমটিম করছে। রাস্তাগুলো কিন্তু খুবই সুন্দর। গুগল ম্যাপ দেখে এগোচ্ছি আমরা। নেভিগেশনের দায়িত্ব পিলিয়নদের (পেছনে বসা সহযাত্রী)। প্রায় দেড় ঘণ্টা ড্রাইভের পর মুজিবনগর কমপ্লেক্স ‘সূর্যোদয়’-এ এলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার। গেটে কেয়ারটেকার টর্চের আলো ফেলতেই সার্চলাইট মনে হলো। ভুতুড়ে সিনেমার মতো এগিয়ে এসে গেট খুলে দিলেন তিনি। পুরো ভবনটা অন্ধকারে মোড়া। সেখানে শুধু আমরা চারজন। রাস্তা থেকে শুরু করে এই সময় পর্যন্ত নিজেদের মনে হচ্ছিল কোনো অ্যাডভেঞ্চার সিনেমার চরিত্র। সুনসান ভবনের দরজা খুললাম। আলোর সুইচ টিপতেই ফিরে এলাম বাস্তবে।
সকালে উঠে আমরা যাই মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে। ওখানে উপস্থিত হন সুধীর মল্লিক, যিনি ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের সময়ও ছিলেন। তিনিই দেখাশোনা করেন স্মৃতিসৌধটা। সামনেই সেই আম্রকানন। সারি সারি আমগাছ। সুধীর মল্লিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে সেদিনের স্মৃতিচারণা করলেন আরেকবার। আমরা তখন মুগ্ধ শ্রোতা। দেখলাম বিশাল একটি লাল মঞ্চ। মঞ্চ ঘিরে আছে ২৩টি দেয়াল। এই দেয়ালগুলো ২৩ বছরের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক। প্রতিটি দেয়ালের ফাঁকে রয়েছে অসংখ্য ছিদ্র। পাকিস্তানিদের অত্যাচারের চিহ্ন এটি। বেদিতে আঁকা হয়েছে অসংখ্য গোলাকার বৃত্ত, যার তাৎপর্য ১ লাখ বুদ্ধিজীবীর খুলি। স্মৃতিসৌধের পাশেই বিশাল এলাকা নিয়ে আছে বাংলাদেশের মানচিত্র। সেখানে একেকটি জায়গার যুদ্ধকালীন ঘটনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোট ছোট ভাস্কর্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের কথা ভাবতেই বুকটা গর্বে ভরে উঠল। তাঁদের যুদ্ধের গল্প নিয়ে কথা বলতে বলতেই সাহস আর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে আমরা রওনা দিলাম কুষ্টিয়ার পথে।
দুপুরে যখন কুষ্টিয়ায় পৌঁছালাম, আমাদের গায়ের নীল টি-শার্ট তখন ধূসর! রাস্তার বর্ণনা আলাদা করে বোঝানোর হয়তো দরকার পড়বে না। কোনোমতে দুপুরে খেয়েই রওনা দিলাম শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি দেখতে। কুষ্টিয়া শহর থেকে প্রায় ৪৫ মিনিটের পথ। দোতলা একটি পরিপাটি বাড়ি। ভেতরে আছে রবিঠাকুরের ব্যবহার করা নানা ধরনের সরঞ্জাম। সবচেয়ে অবাক হলাম রবীন্দ্রনাথের হাতে আঁকা চিত্রকর্ম দেখে। দোতলায় উঠে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম আমরা। বিকেলের মিষ্টি আলো আর সেই রোদে চিকমিক করা দালান যেন নিয়ে যাচ্ছে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে। সন্ধ্যা করে গেলাম লালন শাহর মাজারে। সামনে একতারা আর দোতারার বড় বাজার। টুং টাং আওয়াজ হচ্ছে চারদিকে। ভেতরে ঢুকেই সুরেলা কণ্ঠের আওয়াজ: পারে লয়ে যাও আমায়...।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ