কিন্তু আমি পড়তে পারছি না

>
মেহতাব খানম
মেহতাব খানম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.

সমস্যা

আমার সঙ্গে প্রায় পাঁচ বছর ধরে একটা ছেলের সম্পর্ক। আমাদের বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে, ঘনিষ্ঠ সময় কাটিয়েছি। সবই হয়েছে আমার চাওয়ায়। কখনো ও নিজে থেকে আসেনি। আমি ঢাকা গেলে দেখা হয়েছে। এ মাসেই আমার স্নাতক শেষ হবে, বাসা থেকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এখন ও বলে, ওর বিয়ে করার কোনো চিন্তা নেই। অন্য কারও সঙ্গে মানিয়ে চলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছুদিন ধরে শুনছি অন্য একজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। আমি আসলে বুঝতে পারছি না ও আমাকে সত্যিই ভালোবাসে কি না?

আমার পরীক্ষা চলছে, কিন্তু আমি পড়তে পারছি না, অসুস্থ হয়ে পড়ছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

পরামর্শ

তোমাদের সম্পর্কটি বেশ দীর্ঘদিনের। একসঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর অনেক স্মৃতিও রয়েছে। যেহেতু তুমি ওকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে কল্পনা করে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিলে, তোমার জন্য ছেলেটির বর্তমান আচরণ খুব বড় মানসিক বিপর্যয়ের কারণ হয়েছে। তবে তোমাদের একসঙ্গে সময় কাটানোর পরিকল্পনাটি যে শুধু তোমার উদ্যোগেই হয়েছে, সেটি কি এই ইঙ্গিত দেয় যে ছেলেটি প্রথম থেকেই যথেষ্ট আন্তরিক ছিল না?

যেহেতু সে সব সময় মেঘ না চাইতেই জল পেয়েছে, সে জন্য তোমাকে সে বিশেষভাবে মর্যাদা দেয়নি। তুমি হয়তোবা ওর সঙ্গে দেখা করার জন্য খুব অস্থিরতা বোধ করতে বলে কষ্ট করে প্রতিবার নিজেই ঢাকায় এসে ওর সঙ্গে দেখা করেছ। জানি না এভাবে কতবার তোমাকে এটি করতে হয়েছে, কিন্তু এতে করে ছেলেটিকে এই সম্পর্কটি ধরে রাখার জন্য আর কোনো চেষ্টাই করতে হয়নি।

তোমার অস্থিরতা, আগ্রহকে সম্মান দেখানোর প্রয়োজনও সে বোধ করেনি। যেকোনো সম্পর্ক হচ্ছে একটি চারাগাছের মতো। এই ছোট গাছটিকে আমরা যখন ঠিকমতো পরিচর্যা করি, তখন সেটি সতেজভাবে বেড়ে উঠতে পারে। পরবর্তী সময়ে গাছটি অপূর্ব সুন্দর ফুলে-ফলে ভরে ওঠে যখন প্রতিনিয়ত গাছটিকে যত্ন করা হয়। সম্পর্ক নামের এই গাছটিকে কিন্তু ছেলেটির খুব পরিচর্যা করতে হয়নি। সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সমতা, ভালো বোঝাপড়া খুব প্রয়োজন। হয়তোবা তোমার আবেগীয় চাহিদাগুলো খুব কাজ করেছে বলে তুমি খেয়াল করোনি যে ছেলেটি তোমার চাহিদার ব্যাপারটিতে যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিল না।

এমন কি হয়েছে, তুমি ছেলেটিকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও ঢাকা থেকে গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়নি? তোমার কি কখনো মনে হয়েছে এই সম্পর্কে একটি অসম ব্যাপার ঘটেছে? সেটি যদি আগে থেকেই খেয়াল করতে তাহলে হয়তোবা এত দিন ধরে তুমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত যত্ন নিয়ে সম্পর্কটিকে লালন করতে না।

ছেলেটির অন্য কারও সঙ্গে জড়িয়ে পড়া এবং বিয়ের প্রতি এ ধরনের অনীহা তোমাকে খুব মানসিক যন্ত্রণায় ফেলে দিয়েছে। তুমি একই সঙ্গে প্রত্যাখ্যাত, অসম্মানিত ও প্রবঞ্চিত বোধ করছ। দীর্ঘ সময় যেহেতু একসঙ্গে পথ চলেছ, তোমার মধ্যে একটি শূন্যতাবোধও কাজ করছে।

তবে এর একটি ভালো দিক হচ্ছে ওর সঙ্গে বিয়ের পর যদি অবহেলা, অমর্যাদা ও বিশ্বাসঘাতকতা পেতে তাহলে তো তোমার জীবন আরও দুর্বিষহ হতো, তাই না?

এই সময়ে তোমার পক্ষে লেখাপড়ায় সম্পূর্ণ মনোযোগী হওয়া সম্ভব না হলেও নিজের প্রতি যতটা সম্ভব যত্নশীল হও। একটি মানুষ তোমাকে মূল্যায়ন করতে না পারার অর্থ কিন্তু এই নয় যে তুমি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নও। খুব কাছের কোনো বিশ্বস্ত বন্ধু থাকলে তার সঙ্গে কথাগুলো শেয়ার করে কান্নাকাটি করে নিজেকে হালকা করো। বাবা-মাকেও বলো তুমি এই মুহূর্তে বিয়ে করার কথা ভাবছ না। কারণ, আমরা যখন কোনো সম্পর্ক থেকে তীব্র কষ্ট পাই তখন তা কাটিয়ে ওঠার শক্তি নিজেকেই অর্জন করতে হয়। নেতিবাচক ঘটনাটি থেকে শিক্ষা নিয়ে আবার যখন পথচলার প্রাণশক্তি ফিরে পাই, তখনই একটি নতুন সম্পর্কে ঢোকা সম্ভব হয়।

আশা করছি তুমি কিছু সময় আলাদা করে রাখবে এবং নিজেই নিজের বন্ধু হয়ে আবার নতুন করে মনটিকে গুছিয়ে নেবে।