ওদের শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা

সুদীপের (ছদ্মনাম) বয়স আট বছর, সে একজন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু। তার মা-বাবা দুজনই চাকরি করেন। সকালে সুদীপকে বিশেষ স্কুলে দিয়ে তাঁরা অফিসে চলে যান। দুপুরে একজন গৃহকর্মী ওকে বাসায় নিয়ে আসেন। বিকেলের মধ্যেই মা-বাবা ঘরে ফিরে এসে সুদীপকে সময় দেন। চলছিল ভালোই, কিন্তু কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে সুদীপ দারুণ খিটখিটে হয়ে উঠছে, আগের চেয়ে অনেক বেশি রাগ করছে, কখনো নিজেকে আঘাত করছে, কখনো মা-বাবাকে আঘাত করার চেষ্টা করছে। মা-বাবা তাকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলেন। চিকিৎসক সময় নিয়ে সুদীপকে পরীক্ষা করে তার গায়ে বেশ কিছু শারীরিক আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেলেন! পরে গৃহকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, সুদীপ দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে বিরক্ত করত বলেই গৃহকর্মী মাঝেমধ্যে তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতেন। সেখান থেকেই সুদীপের আচরণের পরিবর্তন।

দিশার (ছদ্মনাম) বয়স ১০ বছর। সে-ও একজন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু। কথা বলতে পারে না। এমনিতে শান্তই। কিন্তু ইদানীং সে ভীষণ ভয় পাচ্ছে। রাতে মোটেই ঘুমাচ্ছে না। ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার করে উঠছে। সারাক্ষণ মাকে আঁকড়ে ধরে রাখছে। খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ। রাতে বিছানা ভেজাচ্ছে, যা আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেন এমনটা হচ্ছে, বোঝার জন্য বাবা-মা মনোচিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করলেন। চিকিৎসক জানালেন, কোনো কারণে দিশা ভয় পেয়েছে। এরপর মা একদিন নিজের চোখে দেখতে পেলেন তাদেরই এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় আদর করার ছলে দিশাকে জাপটে ধরেছে, শরীরের স্পর্শকাতর অংশে হাত দিচ্ছে। তিনি প্রায় মূর্ছা গেলেন এবং বুঝতে পারলেন কেন ইদানীং দিশার আচরণে পরিবর্তন এসেছে।

অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার শিশুদের স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যা (নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার) যেখানে—

শিশুর সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে অসুবিধা হয়, আশপাশের পরিবেশ ও ব্যক্তির সঙ্গে মৌখিক ও ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে যোগাযোগের সমস্যা হয়

এবং আচরণের পরিবর্তন দেখা যায়।

অটিজম বৈশিষ্ট্য আছে এমন শিশুরা যেহেতু বেশির ভাগ সময় নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না, তাই তাদের অনেক না বলা কথা থেকে যায়। তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের অন্যায় হলে তারা সেটা প্রকাশ করতে পারে না। অথবা এমনভাবে তারা সেটা বলার চেষ্টা করে, যা আশপাশের মানুষের জন্য বোধগম্য হয় না। আর যেহেতু অনেক সময় তাদের আচরণজনিত সমস্যা থাকে, তাই তাদের এই মনের কথা বোঝানোর চেষ্টাকে আশপাশের মানুষ আচরণজনিত ত্রুটি বলে মনে করে।

যেকোনো শিশুর ওপরই মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন হওয়ার আশঙ্কা আছে, আর অটিজম আছে এমন শিশুদের দুর্বলতার সুযোগে তাদের ওপরও এ ধরনের নির্যাতনের আশঙ্কা রয়েছে। মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ এম জি এডেলসন ২০১০ সালে তাঁর লেখা এক নিবন্ধে দেখিয়েছেন যে অটিজমের বৈশিষ্ট্য এবং পারিপার্শ্বিক কারণে এসব শিশুর যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঝুঁকি খানিকটা বেশি।

সুরিভান ও নাটসন ২০০০ সালে প্রকাশিত আরেক নিবন্ধে বলেছেন, সাধারণ শিশুদের চাইতে বিশেষ শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়ার হার প্রায় চার গুণ বেশি। অটিজম স্পিকসের তথ্যমতে, বুদ্ধির স্বল্পতা রয়েছে এমন শিশুদের যেকোনো নির্যাতনের শিকার হওয়ার হার সাধারণ শিশুদের চাইতে সাত গুণ বেশি! সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল, যুক্তরাষ্ট্রের জরিপে দেখা যায়, সে দেশে ১৮ বছরের নিচে সব মেয়েশিশুর প্রতি চারজনে একজন আর ছেলেশিশুদের মধ্যে প্রতি ছয়জনে একজন যৌন নিগ্রহের শিকার! সেই হিসাবে অটিজমসহ অন্যান্য বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা কয়েক গুণ বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড অ্যাবিউজ প্রজেক্টের ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশেষ শিশুদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার আর প্রায় ৪১ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার।

অটিজমসহ অন্যান্য বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সার্বিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। অনেক সময় সামাজিক পরিবেশে এ ধরনের শিশুদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয়; দোকানে, শপিং মলে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের উত্ত্যক্ত করা হয় এবং বক্রোক্তি করা হয়। এমনকি স্কুলে বা পরিবারের মধ্যেও এদের কেউ কেউ বিদ্রূপের শিকার হয়ে থাকে, যা একধরনের মানসিক নির্যাতন। আবার অনেক সময় তাদের আচরণের কারণে বিরক্ত হয়ে পরিবারের সদস্য, শিক্ষক বা পরিচর্যাকারীরা তাদের শারীরিকভাবে আঘাত করেন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের ওপর চালানো হয় যৌন নিগ্রহ। একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে বিশেষ শিশুর (মেয়ে বা ছেলে) কিন্তু যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ছেলেশিশুরা নিরাপদ, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।

বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের নিরাপত্তায় করণীয়

  • শিশুর সক্ষমতা অনুযায়ী তাকে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষ করে স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর নাম শেখাতে হবে।
  • ‘স্ট্রেনজার ইস ডেনজার’—এটি সব সময় মাথায় রেখে অপরিচিত বা নতুন কারও কাছে (তিনি পুরুষ হন বা নারী) শিশুকে নিরাপদ মনে করা চলবে না।
  • শিশুকে মা-বা তার শরীরের বিভিন্ন অংশে স্পর্শ করে ‘ঠিক’ বা ‘ঠিক নয়’ বা ‘গুড টাচ’, ‘ব্যাড টাচ’ বিষয়গুলো শেখানোর চেষ্টা করতে হবে।
  • শিশুর আচরণের পরিবর্তনগুলো মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করুন। শিশু হঠাৎ রেগে গেলে, কান্নাকাটি করলে, বিছানায় প্রস্রাব বন্ধ হওয়ার পর আবার শুরু হলে, ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠলে, মা-বাবাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইলে, শিশুর হাঁটাচলার সমস্যা হলে, শরীরে আঁচড়, কামড়ের দাগ দেখা গেলে, বিশেষ কাউকে দেখে ভয় পেলে, মনমরা হয়ে থাকলে বা অন্য কোনো আচরণের হঠাৎ পরিবর্তন হলে সতর্ক হোন। নিপীড়নের বিষয়টি মাথায় রেখে অনুসন্ধান করুন।
  • সামাজিক দক্ষতা শেখাতে হবে। ‘না’ বলার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। এ জন্য ‘বেসিক লাইফ স্কিল’ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হতে পারে।

অটিজম বা অন্যান্য বিশেষ শিশুর ব্যক্তিগত কাজগুলো শেখাতে হবে, যাতে গোসল করা, টয়লেটে যাওয়া বা নিজের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে অপরের সাহায্য না লাগে।

ভাষার ব্যবহার বা ইশারা ভাষা শেখানোর সময় মনে রাখতে হবে যে তারা যেন কোনো ধরনের নির্যাতনের বিষয়টি মৌখিক বা অমৌখিকভাবে বুঝাতে সক্ষম হয়।

তাদের বয়স ও সক্ষমতা অনুযায়ী যৌন বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান দিতে হবে। নারী-পুরুষের সম্পর্ক, গর্ভধারণ, পিরিয়ড বা স্বপ্নদোষবিষয়ক ধারণা দিতে হবে। কোনো অবৈজ্ঞানিক বা ভ্রান্ত বিশ্বাসের মধ্যে তাদের রাখা যাবে না।

যেসব শিশুর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেওয়ার মতো সক্ষমতা নেই, তাদের জন্য বাবা-মা বিশেষ ব্যবস্থা নেবেন। তাদের কখনোই একা রাখবেন না। বিশেষ করে কোনো সেবা বা পরিচর্যা নিতে গেলেও সব সময় সন্তানের সঙ্গে থাকবেন। কারও কথায় প্রভাবিত হয়ে সন্তানকে একা ছাড়বেন না।

যদি অটিজম বা অন্যান্য বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে যায়, তবে বিষয়টি গোপন করবেন না। তাকে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। তার জন্য শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সেবাও প্রয়োজন। আর অবশ্যই বিষয়টি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করবেন। নিপীড়ককে শাস্তির আওতায় আনতেই হবে।