কানকথায় কান না দেওয়া

কিছুদিন আগে আমার বিয়ে হয়েছে। আক্‌দ হয়েছে, বউভাত হয়েছে। নিজের বিয়ে প্রথমবারের মতো খেলাম। তবে আমার নিজের বিয়ের কথা আমি এর আগে অনেকবার শুনেছি। আমার নিজের হিসাবে আমি এর আগে অন্তত সাতজনের সঙ্গে আমার বিয়ের নিশ্চিত সংবাদ পেয়েছি। যার একটার খবরও অন্যের মুখ থেকে শোনার আগে আমি নিজে জানতাম না। পরিচিত মুখ হলে এ রকম গুজব রটবে মেনে নিতে হয়। বেশি আমলে নেওয়া যায় না। বেশি বিচলিত হলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। ধরেন, এই বিয়ের গুজব। আমাকে যখন কেউ এসে জিজ্ঞেস করেছে, ‘এই, তোমার নাকি অমুকের সঙ্গে বিয়ে?’ আমি বলেছি, তাই নাকি? জানতাম না তো। কথা সেখানেই থেমে গেছে। গুজবও কয়েক দিন পর থেমে গেছে।

নানা ধরনের গুজব নিয়ে আমি বিভিন্ন কারণে নির্লিপ্ত থাকতে পারি। তার মধ্যে প্রধান কারণ হলো, আমার পরিবার এবং কাছের মানুষ আমার কথা বিশ্বাস করে। কোনো গুজবে কান দেওয়ার আগে আমার কাছে তার সত্যতা জেনে নেন। গুজবের কারণে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। কিন্তু আমি এ-ও জানি যে এ ক্ষেত্রে সবাই আমার মতো ভাগ্যবান নয়। গুজব যে কী ধরনের ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে মানুষের ওপর, তা আমরা প্রায়ই দেখতে পাই। হয় গণমাধ্যমে অথবা দৈনন্দিন জীবনে।

ধরেন, কোনো মেয়ের ব্যাপারে গুজব রটল যে সে প্রেম করছে। তার পরিবার ব্যাপারটার সত্যতা যাচাই না করে গুজবে কান দিয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে দিল। পরিবারের সমর্থন না পেয়ে সে বাইরের সমাজের কাছে আরও বেশি মানসিক অত্যাচারের সম্মুখীন হলো। একপর্যায়ে যন্ত্রণা না নিতে পেরে সে তার নিজের জীবন নিল অথবা নেওয়ার চেষ্টা করল। খুবই দুঃখজনক হলেও সত্য যে এ রকম ঘটনা আমাদের সমাজে বিরল কিছু নয়। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমের প্রসারের কারণে এ রকম ঘটনা অহরহই ঘটছে।

এখন করণীয় কী? প্রথমেই যেটা বুঝতে হবে, সেটা হলো যে গুজব থামানো খুব কঠিন কাজ। কেউ যদি আপনার সম্বন্ধে কোনো অসত্য কথা বলতে চায়, সেটা থামানোর আসলে কোনো উপায় নেই। তবে এ-ও বুঝতে হবে যে গুজব যারা ছড়ায়, তারা কখনোই আপনার ভালো চায় না। আপনার অমতে আপনাকে নিয়ে মিথ্যে কথা বলছে, এ রকম ব্যক্তি কখনোই আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, যারা অন্যদের নিয়ে গুজব ছড়ায়, তারা সাধারণত ‘ফালতু’ প্রকৃতির মানুষ হয়। যিনি শুভাকাঙ্ক্ষী নন, তাঁর কথায় বিচলিত হওয়াটা বোকামি। তাঁর সঙ্গে কথা বলাটাও বোকামি। হ্যাঁ, তাঁকে গিয়ে বলতে পারেন, দয়া করে আমার সম্বন্ধে বাজে কথা রটাবেন না। গুজব যারা রটায়, তারা বেশির ভাগ সময় ভিতু প্রকৃতির হয়। সোজাসুজি ঠান্ডা মাথায় বলতে পারলে তারা একটা ধাক্কা খায় বটে। তবে বিচলিত দেখলে তারা পেয়ে বসে। সুতরাং তাদের সঙ্গে কোনো প্রকৃতির আলোচনায় যদি যেতেই হয়, সেটা হতে হবে ঠান্ডা মাথায়।

গুজব রটুকের (রটনাকারী) সঙ্গে কথা বলার আগে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেটা সেটা হলো কাছের মানুষের সঙ্গে গুজব নিয়ে একটা সমঝোতায় আসা। মনে করেন, আপনি নিজের ব্যাপারে একটা গুজব শুনলেন এবং আপনার মনে হলো যে সেই গুজবটা আপনার কাছের মানুষদের সঙ্গে আপনার সম্পর্কে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। সবচেয়ে প্রথম কাজ হবে আপনার কাছের এবং ভালোবাসার মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলে তাদের আশ্বস্ত করা। গুজবের অসত্যতার ব্যাপারে তাদের নিশ্চিত করা। শত্রুর সঙ্গে কোনো ধরনের সংঘর্ষে যাওয়ার আগে মিত্রদের কাছে রাখা অপরিহার্য। তবে আমার বিশ্বাস, কাছের মানুষ যদি আশ্বস্ত হয়, তাহলে দেখবেন যে গুজব আপনাকে খুব বেশি বিচলিত করতে পারছে না। যে বা যারা গুজব রটাচ্ছে, তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে যাওয়াটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে।

কেউ গুজবের শিকার হলে তার কাছের মানুষেরও কিছু দায়িত্ব আছে। আমাদের বুঝতে হবে, বিশেষ করে ফেসবুক এবং বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের যুগে যে কারও ব্যাপারে মিথ্যাচার করা বেশ সহজ। যেকোনো খারাপ কথা শুনে তার সত্যতা যাচাই না করেই কোনো কাছের মানুষের সঙ্গে চড়াও হওয়াটা বোকামির কাজ। মূল্যবান এবং সুমধুর সম্পর্কে কয়েকটা ফালতু মানুষের বাজে কথার কারণে ব্যাঘাত ঘটানো থেকে যতটা বিরত থাকা যায় ততই ভালো।

আমাদের জীবনে এমনিতেই নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। বাজে লোকের বাজে কথায় কান দেওয়ার আমাদের সময় নেই। তাই সবার কাছে অনুরোধ যে গুজবে কান দেবেন না। নিজের ব্যাপারে, ভালোবাসার মানুষগুলোর ব্যাপারে।

লেখক: অভিনেতা