আমার মা সেরা মা

মা এনতা মান্দার জীবন–লড়াইটা মনের ভেতরে পুষে রাখেন মারিয়া মান্দা। ছবি: প্রথম আলো
মা এনতা মান্দার জীবন–লড়াইটা মনের ভেতরে পুষে রাখেন মারিয়া মান্দা। ছবি: প্রথম আলো
>

আগামীকাল মা দিবস। পাঠকদের জন্য মায়ের কথাই লিখেছেন, জনপ্রিয় ফুটবলার মারিয়া মান্দা।

বাবার চেহারা কেমন ছিল, মনে নেই। বাবার একটা ছবিও নেই যে দেখব। কখনো বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করলে মায়ের মুখটা সবার আগে মনে পড়ে। বাবা বীরেন্দ্র মারাত যখন মারা যান, তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। আমার ছোট ভাই দানিয়েল মান্দা ছিল মায়ের গর্ভে। সেই থেকে আমাদের চার ভাইবোনকে নিয়ে মা এনতা মান্দার লড়াইটা শুরু। আমাদের নিয়ে এখনো লড়ে যাচ্ছেন মা।

ময়মনসিংহের মন্দিরগোনা গ্রামে আমাদের বাড়ি। আমাকে ফুটবলার বানানোর পেছনে বড় অবদান মায়ের। যখন কলসিন্দুর স্কুলে মফিজ স্যারের কাছে আমরা ফুটবলের অনুশীলন করতাম, গ্রামের অন্যরা নানা সমালোচনা করত। অনেক বাবা-মা পড়াশোনার ক্ষতি হওয়ার ভয়ে মেয়েদের খেলতে পাঠাতে চাইতেন না। কিন্তু আমার মা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কখনো যদি অনুশীলনে যেতে দেরি হতো, বকাবকি শুরু করে দিতেন মা।

আমার মা অন্যের জমিতে কাজ করেন। ধানের মৌসুমে ধান লাগান, মৌসুম শেষে ধান কাটার কাজ করেন। এ জন্য দিনে দুই শ টাকা পারিশ্রমিক পান। শত অভাবেও আমার কোনো চাওয়া কখনো অপূর্ণ রাখেননি। আমার এখনো মনে পড়ে, ছোটবেলায় বুট কিনতে চাইলে চাল বিক্রি করে সেটা কিনে আনতেন মা। খেলার অন্য সরঞ্জামও কতবার কিনে দিয়েছেন এভাবে!

ইদানীং জাতীয় দলে খেলার সুবাদে ফুটবল ফেডারেশন থেকে টাকা পাই। ফুটবল খেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দুই দফা এক লাখ করে টাকা পেয়েছি। ওই টাকা দিয়ে মা কিছু জমি বন্ধক রেখেছেন। কিছু ঋণ শোধ দিয়েছেন। আসলে আমার মা বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে আমাদের বড় করে তুলছেন।

খেলার সুবাদে, জাতীয় দলের ক্যাম্পে থাকার জন্য ঢাকাতেই নিয়মিত থাকতে হচ্ছে। ভালো ভালো খাবার খাচ্ছি। কিন্তু মায়ের হাতের রান্নার সেই স্বাদ কোথায়? ছুটিতে বাড়ি গেলে মা আমার প্রিয় শুঁটকি ভর্তা করে রাখেন। আমার বয়স ১৫ বছর। এতটুকু বয়সেই আমার কত দেশ ঘোরা হয়ে গেল শুধু খেলার সুবাদে। প্রতিবার উড়োজাহাজে ওঠার সময় ভাবি, আহা, একবার যদি মাকে নিয়ে অন্তত উড়োজাহাজে চড়তে পারতাম। কিন্তু আমার সেই সাধ্য নেই, সামর্থ্যও নেই।

আমার মা সব সময় পাশেই আছেন। সব সময় মনে হয় মায়ের কথা। মা সব সময় আমার মনের মধ্যে রয়েছেন। একবারের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। তখন আমি সম্ভবত তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। খেলতে গিয়ে বাম হাত ভেঙে গেল। আমাকে নিয়ে সে কী অস্থিরতা মায়ের। কবিরাজের কাছে নিয়ে গেলেন, এক মাস রাতে ঘুমাননি মা।

গ্রামে যখন ফুটবল খেলতাম, মায়ের চিন্তা থাকত আমার যাতায়াত নিয়ে। আগে আমাদের গ্রামের নেতাই নদীতে সেতু ছিল না। ভোরে নদীতে নৌকা পাওয়া যেত না। কীভাবে আমাকে ওপারে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেটাই ছিল মায়ের একমাত্র চিন্তা। এমনও হয়েছে, মাঝিকে ফোন করে আগেই বলে রাখতেন আমি খেলতে যাব। কোনো কোনো দিন মাঝি না থাকলে মা নৌকা বেয়ে আমাকে পার করে দিয়ে আসতেন।

আমাদের কোনো খেলা যদি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হতো, সেটা যেভাবেই হোক মায়ের দেখতেই হবে। অনেক সময় সব খেলা বিটিভিতে দেখায় না। কিন্তু খেলা দেখার জন্য অনেক দূরের গ্রামে গিয়ে বসে থাকেন মা।

আমার বড় বোনের নাম হাসি। আগে সবাই মাকে ডাকতেন হাসির মা। এখন বলেন মারিয়ার মা। আমাকে দিয়েই মায়ের পরিচিতি। সবাই বলে, আপনি মারিয়ার মা। আপনার মেয়ে তো চমৎকার খেলে। দোকানে বা যেকোনো জায়গায় গেলে সবাই সম্মান করে। মা এতে খুব খুশি হন।

আজ আমার যে পরিচিতি আর সম্মান, এসবই মায়ের জন্য। এক কথায় বলব, আমার মা পৃথিবীর সেরা মা।

ফুটবলার, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দল