আম্মুর হাসিমুখের জন্য

ইমরানের অনুপ্রেরণা মা সেলিনা হক
ইমরানের অনুপ্রেরণা মা সেলিনা হক
>

আগামীকাল মা দিবস। পাঠকদের জন্য মায়ের কথাই লিখেছেন, জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ইমরান মাহমুদুল।

আমার গানের স্কুল তখন ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় ছিল। বাসা ডেমরায়। প্রতিদিন যাতায়াত করতে হতো বাসে। একদিনের ঘটনা—ক্লাস শেষ, ফার্মগেট থেকে বাসায় ফিরব। বাস এল, আমি তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লাম। ভেতরে ঢুকতেই বুঝতে পারলাম আম্মু উঠতে পারেননি। বাস তো এরই মধ্যে ছেড়ে দিয়েছে। বাইরে আম্মুর চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি কান্না আটকাতে পারলাম না। ততক্ষণে বাস একটানে অনেকটা দূরে চলে এসেছে। আমার বুকফাটা কান্নায় বাসের সব যাত্রী হকচকিয়ে উঠল। চালককে থামাতে বলল বাস। অতঃপর কাঁদতে কাঁদতে নেমে পড়লাম আমি। পেছনে তাকিয়ে দেখি আম্মু তখনো দৌড়াচ্ছেন। মনে হলো, এখানে না নামিয়ে দিলে তিনি যেন বাসের পেছনে পুরোটা পথ এভাবে দৌড়াতে থাকতেন।

সেদিনের সেই স্মৃতি মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে। আমাকে গায়ক বানাতে কী কষ্টটাই না তিনি করেছেন; কতটা মমতায় আগলে রাখতেন আমাকে। রাখতেন বলছি কেন, এখনো তো তেমনই। যখন ঢাকার বাইরে থাকি বা চলে যাই দেশের বাইরে, আম্মু নিয়ম করে খোঁজ নেন। মায়ের সব সময়ের স্বপ্ন, আমাকে বড় কোনো জায়গায় দেখবেন। জানি না কতটুকু পেরেছি। তবে আমি এখনো তাঁর সেই স্বপ্নের জায়গায় যাওয়ার চেষ্টাই করে যাচ্ছি।

গানের ক্লাস ঘিরেই মায়ের সঙ্গে অধিকাংশ স্মৃতি। ছোটবেলার অনেকটা সময় তো গানের স্কুলেই কাটিয়েছি। গানে আমার হাতেখড়ি ডেমরার এক স্কুলে। সেভেনে ওঠার পর স্কুল বদলে ভর্তি করানো হয় ফার্মগেটের একটি গানের স্কুলে। আমি দুপুরে স্কুলের ক্লাস শেষে বাসায় ফিরতাম, মা রোজকার সব কাজ সামলে তৈরি হতেন আমাকে নিয়ে ফার্মগেট আসার জন্য।

সে সময়ের আরও একটি ঘটনা মনে এখনো দাগ কেটে আছে। মহানগর নাট্যমঞ্চে (কাজী বশীর মিলনায়তন) তখন নিয়মিত অনুষ্ঠান হতো। এমন একটি আয়োজনে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পেলাম বাবার এক সহকর্মীর মাধ্যমে। তিনি আয়োজকদের মধ্যে একজন ছিলেন। মঞ্চে গান গাইব শোনার পর থেকেই আমি তো ভীষণ উত্তেজিত। আমার চেয়ে মায়ের চাপা উত্তেজনা ছিল আরও বেশি। কারণ, ওই অনুষ্ঠানে সে সময়ের নামকরা কয়েকজন শিল্পীর গান করার কথা ছিল। আব্বু আমাদের কাছাকাছি সব আত্মীয়স্বজনকে জানালেন। সবাইকে আসতে বললেন আমার গান শোনার জন্য।

অনুষ্ঠানের দিন মা-বাবার সঙ্গে আমি গেলাম। নিকটাত্মীয়রা অনেকে এলেন। সময় গড়াচ্ছিল, কিন্তু আমাকে ডাকা হচ্ছিল না। আব্বু একসময় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। দেখলাম তিনি গিয়ে আয়োজকদের বারবার বলছেন, আমাকে কখন সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু আব্বুকে এটা-সেটা বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তাঁরা। শেষ সময়ে এসে তিনি বুঝতে পারলেন। আমাকে এসে বললেন, ‘আমাদের দেরি হয়েছে, চলো বাসায় চলো।’

গান গাইতে পারব না জেনে খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। সে কষ্টের মাত্রা আরও বেড়ে গিয়েছিল মায়ের জন্য। দেখি দর্শকসারির এক প্রান্তের একটি চেয়ারে বসে অঝোরে কাঁদছেন আম্মু। তখন জেদ চেপেছিল, একদিন বড় কোনো মঞ্চে গান করব, আম্মু সঙ্গে থাকবেন, দেখবেন সে আয়োজন শুধু তাঁর সন্তানকে ঘিরেই। এখন ঢাকার কাছাকাছি ভালো আয়োজনে আম্মুকে সঙ্গে নিয়ে যাই। আমার টিভি অনুষ্ঠানগুলোও দেখেন তিনি। কিন্তু সে দিনের গান না করতে পারার কষ্ট, মায়ের চোখের সেই জল আজও আমাকে পীড়া দেয়। এসব কষ্টই হয়তো আমাকে একজন গায়ক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।

এই যে ‘সেরাকণ্ঠে’ আমি এলাম, এর পেছনেও আম্মুর ভূমিকা। ‘সেরাকণ্ঠে’ আমার প্রথম অডিশন ছিল বরিশালে। আম্মুই আমাকে বরিশালে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুই রাত সেখানে থাকতে হলো। ইয়েস কার্ড পাওয়ার পর আনন্দ নিয়ে ঢাকায় ফিরলাম। এরপর প্রতিটি ধাপেই ছিল আম্মুর অনুপ্রেরণা।

এই যে এত কিছু বলছি, মনে হচ্ছে আম্মু তাঁর পুরোটা সময় আমাকেই দিয়েছেন। তা কিন্তু নয়, আমার দুই বোনও যদি নিজেদের কথা লেখেন, ঠিক এভাবেই আম্মুর কথা চলে আসবে। তাঁদের সব সময়ের সঙ্গী ছিলেন আম্মু। আর তাঁকে নীরবে সহযোগিতা করে যেতেন আব্বু।

এখন নতুন কোনো গান নিয়ে কাজ শুরু করলে আম্মুকে আগে স্টুডিওতে এনে সেটা গেয়ে শোনাই। আম্মু ভালো বললে সাহসী হই, সামনে এগোই। সত্যি বলতে, আজকের ইমরান হয়ে ওঠার পেছনে আম্মুর অবদান সবচেয়ে বেশি। জীবনে যত বাধাই এসেছে, সেগুলো উতরাতে পেরেছি আম্মুর জন্যই। তাই এই জীবনে আম্মুর হাসিমুখই আমার পরম পাওয়া।

লেখক, সংগীতশিল্পী