মা বলে কথা

>কয়েক দিন আগেই প্রকাশিত হলো এসএসসি পরীক্ষার ফল। সারা দেশে এক লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এদের মধ্যে রাজশাহীর পুঠিয়ার নওপাড়া গ্রামের আমিন আলীর গল্পটা অন্য রকম কেন? আজ মা দিবসে শুনুন হতদরিদ্র সংসারে এক মা-ছেলের জীবনসংগ্রামের কাহিনি। লিখেছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
মা–ছেলের মুখে এখন হাসি। ছবি: শহীদুল ইসলাম
মা–ছেলের মুখে এখন হাসি। ছবি: শহীদুল ইসলাম

আমিন আলী জিপিএ-৫ পেয়েছে। ওর মা হাজেরা খাতুনের মন আনন্দে ভরে গেছে তাতে।

যারা এবার এসএসসিতে ভালো ফল করেছে, তাদের সবার পরিবারেই এই আনন্দ। আমিনের জন্য আলাদাভাবে লিখতে হচ্ছে কেন?

লিখতে হচ্ছে এই জন্য যে, স্কুলে যাওয়ার জন্য ও যে শার্টটা পরত, সেটা বানানো হয়েছিল ক্লাস সিক্সে থাকতে। সেই পোশাকেই ও পাড়ি দিয়েছে ক্লাস টেন পর্যন্ত পথ। খুব বেশি পরা হয়নি বলে শার্টটা ছিঁড়ে যায়নি, তবে এখন গায়ে আঁটসাঁট হয়ে যায়।

লিখতে হচ্ছে এই জন্য, ওর মা কাজ করেন চাতালে, ইটের ভাটায়। সারা দিন পরিশ্রম করে যা পান, তা দিয়েই কিছু কিনে আনেন বাজার থেকে, তারপর তাদের খিদে মেটে। বহুদিন আমিনকে স্কুলে যেতে হয়েছে না খেয়ে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে হাঁড়ি-পাতিল উল্টে দেখেছে, কিছু নেই। পেটে পাথর বেঁধেই কেটেছে সময়। মা এসেছেন, রান্না করেছেন, তারপর মা-ছেলে খেয়েছে কিছু।

নারী শ্রমিক হাজেরা খাতুনের সংসার ‘চলে চলে চলে না’। তারপরও তিনি চেয়েছেন ছেলে পড়াশোনা করুক। একটা জেদ তাঁকে এই শক্তি দিয়েছে।

কী সেই জেদ?

সে কথা বলতে হলে ফিরতে হবে পেছনে। ফিরতে হবে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার নওপাড়া গ্রামে। হতদরিদ্র বাবা অল্প বয়সেই হাজেরাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। স্বামীর বাড়িতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, তাঁর আগেই তাঁর স্বামী আরও দুটি বিয়ে করেছেন। তাঁদের একজন তখনো সংসারে রয়েছেন। বাবার সংসারের দৈন্যের কথা ভেবে সব মেনে নিয়ে স্বামীর সংসার শুরু করেছিলেন হাজেরা খাতুন। সংসারে প্রথম এল মেয়ে, এরপর ছেলে।

মেয়ের পরে যখন ছেলে হলো, স্বামীর প্রথম পক্ষের ছেলেমেয়েরা হাজেরা খাতুনকে আর মেনে নিতে পারেন না। ফুপুশাশুড়িসহ এই ছেলেমেয়েরা তাঁর ওপরে অত্যাচার শুরু করেন। একপর্যায়ে স্বামী তাঁকে তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন।

সেই থেকে হাজেরার যুদ্ধ শুরু হলো।

ইটের ভাটায় কাজ করেন হাজেরা খাতুন
ইটের ভাটায় কাজ করেন হাজেরা খাতুন

দুই সন্তান বুকে করে রাস্তায় নেমে আসেন তিনি। যাবেন কোথায়? শেষমেশ বাবার সংসারেই ফিরে আসেন। কিন্তু বাবার সংসার তো শতছিন্ন ছাতা। বাবা  মেয়ের থাকার জন্য শুধু দুই শতাংশ জমির ওপরে একটি খুপরি ঘর তুলে দেন। সে ঘরে কোনো খাবার নেই। বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁর জন্য দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু কোথায় গেলে দুমুঠো খাবার জুটবে, কেউ তা বলেন না। প্রথম কয়দিন সারা দিন কোনো খাবার জোটাতে পারেন না। রাতে প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে আটা চেয়ে এনেছেন। রুটি বানালে তরকারি লাগবে, তাই আটাই খেয়েছেন লবণ-পানিতে গুলিয়ে। সেই থেকে প্রথমে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ ও পরে মাঠের কাজ শুরু করেন।

আমিনের যখন এক বছর বয়স, ওর বোনের আড়াই, তখন এক বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন মা। মেয়েকে গৃহস্থবাড়ির বারান্দায় রেখে বাড়ির কাজ করতেন হাজেরা। মেয়ের খিদে পেলে সে চলে আসত মায়ের কাছে। মেয়েকে দেখেই চটে উঠতেন গৃহকর্ত্রী—খাওয়ার সময় হলেই আপদ জোটে! মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। মা কি আর খেতে পারেন? নিজের খাবারটা নিয়েই মেয়েকে খুঁজতে বের হন।

এই কষ্টে ঝিয়ের কাজ ছেড়ে দিয়ে মাঠে নামেন। হয়ে যান নারী শ্রমিক। এরপরই ধানের চাতালে, ইটের ভাটায় কাজ করতে শুরু করেন। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে করতেই দিন কেটে যায়। মেয়ে মেধাবী ছিল, কিন্তু অর্থের অভাবে ওকে বেশি দূর পড়াতে পারেননি, অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমিনকে হাল ছাড়তে দেননি।

কীভাবে পড়াশোনা করেছে আমিন? পুঠিয়ার ধোপাপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের এই ছাত্র জানত, শুধু পড়াশোনা ওর মুখে ভাত তুলে দেবে না। তাই ও মা হাজেরা খাতুনকে কাজে সাহায্য করে। সপ্তাহে কয়েক দিন পুঠিয়ার নওপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী আবদুস সামাদের দোকানে কাজ করে। ভোর থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত ট্রাক থেকে সার ও সিমেন্ট নামাতে হয়। তা ছাড়া রাতে মাছের গাড়িতে ঢাকা ও সিরাজগঞ্জে যায়। সারা রাত পা দিয়ে ট্রাকের পানি নাড়তে হয় যাতে মাছ অক্সিজেন পায়, ঢাকায় যাওয়া পর্যন্ত মাছগুলো তাজা থাকে। এক ট্রাক মাছ ঢাকায় পৌঁছে দিলে ২০০ টাকা পারিশ্রমিক পাওয়া যায়। কখনো ব্যবসায়ী তার সঙ্গে ১০০ টাকা বকশিশ দিয়ে থাকেন।

নিজের খুপরি ঘরের বারান্দায় ছেঁড়া পাটিতে বসে ছেলের কথা বলতে বলতে হাজেরা বেগম তাঁর চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না। এই চোখের পানিতে ছিল কষ্ট, ছিল আনন্দ। তিনি বললেন, ‘আমাকে সাহায্য করার জন্য ছেলেটা সপ্তাহের সব দিন বিদ্যালয়ে যেতে পারেনি।’

মুঠোফোনে ধোপাপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমান বলেন, তিনি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন যে ছেলেটির     মেধা রয়েছে। মাঝখানে খেয়াল করেন সে আর বিদ্যালয়ে আসে না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন নিয়মিত মাঠের কাজ করার জন্য    আমিন আলী ঠিকমতো বিদ্যালয়ে আসতে পারছে না। অন্য শিক্ষকেরা সেটা জানতেন না। তাঁরা হয়তো বকাবকি করতেন। পরে তিনি শিক্ষকদের বলে দিয়েছিলেন, আমিন যে কয়দিনই বিদ্যালয়ে আসুক, তার বাড়তি যত্ন নিতে হবে। তার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য বিদ্যালয় থেকে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে।

আমিন আলীর বাড়িতে বসে তার পড়াশোনার গল্প শোনার সময় প্রতিবেশী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমিন আলী যেভাবে লেখাপড়া করছে, কোনো মানুষের পক্ষে এত কষ্ট করে লেখাপড়া করা সম্ভব না।’

জীবনের স্বপ্ন বা লক্ষ্য কী—জানতে চাইলে আমিন আলী বলে, ‘আমাদের মতো মানুষের তো স্বপ্ন দেখাই ঠিক না। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লেখাপড়া শেষ করে একটা কাজের জোগাড় করতে চাই। যেন মাকে আর অন্যের কাজে যেতে না হয়। এটাই জীবনের একমাত্র স্বপ্ন।’