ভালোবাসি বলব নাকি বলব না?

দ্বিধা থাকে মনে। ভালোবাসার কথা বলব, নাকি বলব না? মডেল: রাজন ও তুর্জি ছবি: সুমন ইউসুফ
দ্বিধা থাকে মনে। ভালোবাসার কথা বলব, নাকি বলব না? মডেল: রাজন ও তুর্জি ছবি: সুমন ইউসুফ
>আমি তোমাকে ভালোবাসি—এটা মুখে বলার সাহস যদি কোনোভাবেই না হয়, তাহলেও প্রকাশের অনেক উপায় আছে। লিখে বলা যায়। গানের মাধ্যমে বলা যায়। অন্য ভাষায় বলা যায়। শেষের উপায় বিশেষভাবে কার্যকরী। কোনো অচেনা ভাষায় আমি তোমাকে ভালোবাসি বলার মধ্যে একধরনের ভৌগোলিক রোমাঞ্চকর বিষয় জড়িয়ে থাকে। ভালোবাসার কোমল অভিব্যক্তির পাশাপাশি নতুন কিছু জানা এবং জানানোর আনন্দও আপনাকে এবং আপনার ভালোবাসার মানুষটিকে দিতে পারে।

 

আমি তোমাকে ভালোবাসি। এই কথা আমরা বাঙালিরা খুব সহজে বলতে পারি না। সারাক্ষণ পাঁয়তারা কষতে থাকি কীভাবে এই তিন শব্দ না বলে থাকা যায়। এটা কেন হয়, তা নিয়ে অনেক কথা বলা যেতে পারে। তবে সেটা আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। কাউকে ভালোবাসলে সেটা বলে ফেলা উচিত। বিষয়টা একদমই সহজ না হতে পারে, তারপরও বলাটা খুব জরুরি।

এখানে বলা দরকার যে ভালোবাসা বলতে আমি শুধু রোমান্টিক ভালোবাসা বোঝাচ্ছি না। যেকোনো ধরনের ভালোবাসা হতে পারে। মা-বাবার ভালোবাসা, ভাই-বোনের ভালোবাসা, বন্ধুদের ভালোবাসা এবং অবশ্যই রোমান্টিক ভালোবাসা।
একজন মানুষের জীবনে আসলে আবেগ কেন জরুরি? আবেগ জরুরি, কারণ, যেকোনো পরিস্থিতিতে আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হওয়া উচিত, আবেগ তার দিকনির্দেশনা দেয়। আবেগ থেকে আমরা বুঝতে পারি বিভিন্ন পরিস্থিতে আমাদের কী কী করণীয়। মনে করেন আপনি খুব মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করছেন। এ রকম অবস্থায় আপনার বন্ধু এসে আপনার কানের কাছে জোরে জোরে গান গাওয়া শুরু করল। এমতাবস্থায় আপনার প্রতিক্রিয়া কী হওয়া উচিত, সেটা বলে দেবে আপনার আবেগ। এমন হতে পারে, বন্ধুর গান শুনে আপনার খুব রাগ হচ্ছে। তখন সঠিক প্রতিক্রিয়া হবে বিরক্তি প্রকাশ করে বন্ধুকে গান থামানোর কথা বলে দেওয়া। অথবা এমনও হতে পারে যে একটা গম্ভীর মুহূর্তে বন্ধুর গান শুনে আপনার হালকা লাগল। আপনি আনন্দিত হলেন। তখন প্রতিক্রিয়া হবে বন্ধুর সঙ্গে কিছুক্ষণ গান করে আবার কাজে ফেরত যাওয়া। এ রকম জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আবেগ আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে আমরা কীভাবে আচরণ করব।

এখন আবেগ আমাদের যে প্রতিক্রিয়ার পরামর্শই দেয়, সেই পরামর্শ যদি আমরা উপেক্ষা করি, তাহলে কী হতে পারে? গায়ক বন্ধুর উদাহরণেই আবার ফিরে যাই। মনে করেন বন্ধুর গানে আপনি বিরক্ত হচ্ছেন। বিরক্ত হওয়া সত্ত্বেও আপনি কিছু বলছেন না অথবা জোরালোভাবে কিছু বলছেন না। বন্ধু মনে করছে যে তার সংগীতচর্চা আপনাকে খুব বেশি ত্যক্ত করছে না এবং সে গান চালিয়েই যাচ্ছে। একপর্যায়ে আপনি ভয়ংকর রেগে যাবেন। যেখানে দুটো কথায় পরিস্থিতির অবসান ঘটত, সেখানে অন্তত চারটা কথা হবে। ভাঙাভাঙি-মারামারি হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এভাবে একবার আমি আমার নিজেরই একটা ভালো গিটার মাটিতে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলেছিলাম। থাক সে কথা। আসল কথা হলো আবেগের যথার্থ বহিঃপ্রকাশ জরুরি।

আসি ভালোবাসার প্রসঙ্গে। এখানে যেটা বলা উচিত। মনোবিজ্ঞানে আমরা মূল আবেগ বলতে যা বুঝি, ভালোবাসা তার মধ্যে পড়ে না। ভালোবাসা আসলে বিভিন্ন আবেগের একটা সমন্বয়। তবে হ্যাঁ, খুব শক্তিশালী একটি সমন্বয় বটে। আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি, তখন আমাদের মধ্যে অনেকগুলো মৌলিক আবেগ, যেমন বিশ্বাস, সুখ, এমনকি ভয় একই সঙ্গে অনুভব করি এবং খুব জোরালোভাবে অনুভব করি। এই অবস্থায় ভালোবাসার প্রকাশ যদি যথাসময় যথাযথভাবে না ঘটে, তাহলে তার ফলাফল যে খুব ইতিবাচক হবে, সেটা ভাববার কোনো কারণ নেই।

এখন বলা যেতে পারে যে কাউকে ভালোবাসলে সেটা বলার কী দরকার, কর্ম ও ব্যবহারের মাধ্যমে দেখিয়ে দিলেই তো হয়। কথা আংশিক সত্য। কর্ম ও ব্যবহারের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ করা আবশ্যক। সেটা না করে শুধু মুখে বললে ভালোবাসাটা ফাঁপা হয়ে যাবে। কিন্তু মুখেও বলতে হবে। বিভিন্ন আবেগ ভাষা ও ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা প্রকাশ করতে পারি বলেই আমরা অন্য কোনো প্রাণীর থেকে ভিন্ন। ভাষার এই প্রতিভা যখন আমরা ঠিকভাবে ব্যবহার না করি, তখনই আমাদের আচরণ পাশবিক হয়ে যায়। আমরা মারামারি করি, যুদ্ধ করি। গিটার ভাঙি। পাশবিক আচরণ করা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ঠিক সে কারণে কাউকে ভালোবাসলে সেটা আমাদের ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা উচিত।
আমি তোমাকে ভালোবাসি—এ কথাটা বলা অনেক ক্ষেত্রেই খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে যে দুটি মানুষকে আমরা সাধারণত সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, অর্থাৎ আমাদের মা-বাবা, তাঁদেরই দেখা যায় মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কারণে। তবে আমি কখনো দেখিনি যে কোনো সন্তান মা-বাবাকে বলেছে আমি তোমাকে ভালোবাসি আর মা-বাবা যারপরনাই খুশি হননি। তাঁরা যতই ডাকসাইটে মা-বাবা হোন না কেন।

আমি তোমাকে ভালোবাসি—এটা মুখে বলার সাহস যদি কোনোভাবেই না হয়, তাহলেও প্রকাশের অনেক উপায় আছে। লিখে বলা যায়। গানের মাধ্যমে বলা যায়। অন্য ভাষায় বলা যায়। শেষের উপায় বিশেষভাবে কার্যকরী। কোনো অচেনা ভাষায় আমি তোমাকে ভালোবাসি বলার মধ্যে একধরনের ভৌগোলিক রোমাঞ্চকর বিষয় জড়িয়ে থাকে। ভালোবাসার কোমল অভিব্যক্তির পাশাপাশি নতুন কিছু জানা এবং জানানোর আনন্দও আপনাকে এবং আপনার ভালোবাসার মানুষটিকে দিতে পারে। আমি তোমাকে ভালোবাসি না শুনে যদি মা বা ভাই চায়নিজ ভাষায় ‘ও আই নি’ শুনে তাহলে অপ্রস্তুত হবে না। কৌতূহলী হবে। ‘ও আই নি’ যতক্ষণে আমি তোমাকে ভালোবাসিতে এসে ঠেকবে, ততক্ষণে আপনি এবং ভালোবাসার মানুষ দুজনেই ভালোবাসা প্রকাশের বিষয়টিতে ধাতস্থ হয়ে যাবেন।

আমি তোমাকে ভালোবাসি। যে করেই হোক ভালোবাসার মানুষটিকে এই কথা বলতে হবে। সামাজিক মাধ্যমের কারণে এখন অনেকজনের দুঃখকষ্টের কথা আমরা এখন জানতে পারি। কাছের কেউ চলে যাওয়ার পর যে জিনিসটা আমি বেশির ভাগ মানুষকে বলতে দেখি, সেটা হলো, ‘তুমি থাকতে তোমাকে কখনো বলা হয়নি আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি’। এই আক্ষেপ যাতে আমি আর আপনি আর অনুভব না করি।
সবাই আমরা বলতে চেষ্টা করি, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

লেখক: অভিনেতা