ভুল সিদ্ধান্ত যেন না নেয় সে

চলো আবার নতুন করে শুরু করি।
চলো আবার নতুন করে শুরু করি।

সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ১১ জন পরীক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়া প্রায় ১০০ জনেরও বেশি পরীক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। আবার গত কয়েক মাসে প্রায় ৬ জন মেডিকেল শিক্ষার্থীও আত্মহত্যা করেছে! কোনো কোনো সময় ব্যক্তিগত সমস্যা, সম্পর্কের জটিলতা, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি কারণেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে, কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পর এবং মেডিকেলের পরীক্ষাকে কেন্দ্র করেই আত্মহত্যার ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। এটি কেবল এই বছরের ঘটনা তা নয়, প্রায় প্রতিবছরই এমন ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।

প্রত্যাশার সঙ্গে যখন প্রাপ্তি মেলে না, যখন একজন কিশোর-তরুণ মনে করে তার এই ব্যর্থতা পরিবারকে লজ্জিত করবে, বিব্রত করবে, তখন সে এই ভুল কাজটি করে থাকে। পরীক্ষা-পূর্ববর্তী সময়ে এবং ফল প্রকাশের পর পরিবারের সদস্যদের আচরণ কখনো কখনো তাদের এই হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করে। একজন শিক্ষার্থীর ব্যর্থতায় তার পরিবার আর বন্ধু-স্বজনদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে তা বহুলাংশে সেই শিক্ষার্থীর আচরণের জন্য দায়ী।

যেমন ভারতের মধ্যপ্রদেশে আশু নামের এক ছেলে মাধ্যমিকে চার বিষয়ে অকৃতকার্য হয়ে বাড়ি ফিরলে তার বাবা সুরেন্দ্র ব্যাস তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘মন ভাঙবে না, ভবিষ্যতে তুমি ভালো ফল করবে।’ এরপর বাড়িতে বন্ধু-স্বজনদের ডেকে তিনি ছেলেকে উত্সাহ দিতে এক ঘরোয়া উত্সবেরও আয়োজন করেন। বাবার এই আচরণ নিঃসন্দেহে আশুকে প্রেরণা জুগিয়েছে, যেকোনো নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রেখেছে। একজন উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণী যখন কোনো কাজে ব্যর্থ হন, তখন নিজে তিনি যতটা দুঃখবোধে আক্রান্ত হন, তার চেয়ে সে বেশি আলোড়িত হন এই ভেবে যে তাঁর পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে মা-বাবারা বিব্রত হবেন। কারণ পরীক্ষার আগে থেকেই কিছু কথা ও আচরণ তাঁকে এমনটা ভাবতে প্রভাবিত করে। কোনো কোনো মা-বাবা সরাসরি সন্তানের ওপর লক্ষ্য চাপিয়েই দেন, ‘তোমাকে জিপিএ-৫ পেতেই হবে।’ আবার কেউ সরাসরি বলেন না কিন্তু হয়তো বলেন, ‘তোমার চাচাতো ভাই এত ভালো রেজাল্ট করেছে, তুমি যদি ওর চেয়ে খারাপ করো, তবে আমরা মুখ দেখাব কী করে?’ এই ধরনের আলাপন কিশোর সন্তানটির মনোজগতে ঝড় তোলে, সে তখন নিজের জন্য নয়, মা-বাবার জন্য ভালো ফল করতে চায়। আর কোনো কারণে প্রত্যাশিত ফল না হলে বা ফল বিপর্যয় হলে সে আত্মহত্যার মতো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। মনে রাখতে হবে যে ব্যর্থতাই জীবনের শেষ কথা নয়, ব্যর্থতাকে আঁকড়ে ধরে থাকলে সফলতা প্রবেশ করতে পারবে না। বিষয়টি কিন্তু মা-বাবা আর অভিভাবকদের বেশি করে মনে রাখতে হবে। কেবল সাফল্য নয়, মাঝেমধ্যে ব্যর্থতাকেও উদ্‌যাপন করার প্রয়োজন হতে পারে।

ফল খারাপ হলে কী করবে
ফল যেকোনো কারণে খারাপ হতেই পারে। এ জন্য নিজেকে তো নয়ই, কাউকে দায়ী করা যাবে না। মনে রাখতে হবে যে একটি খারাপ ফল অর্থ হচ্ছে জীবনের অভিজ্ঞতা। হয়তো খারাপ ফলের জন্য সাময়িক কষ্ট অনুভব করবে কিন্তু মনে রাখতে হবে যে একটি ফলই জীবনের শেষ ফল নয়। সামনে আরও পরীক্ষা আছে, হতাশ না হয়ে সামনের পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।

হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিয়ে প্রয়োজনে মা-বাবা, শিক্ষকদের সঙ্গে মনের অবস্থাটি খুলে বলতে হবে। মনে যদি কোনো নেতিবাচক চিন্তা আসে, তবে তা অন্যের কাছে খুলে বলার সঙ্গে সঙ্গেই নেতিবাচক চিন্তার তাড়না অনেকখানি কমে যাবে।

যারা খারাপ ফল করেছে, তারা একসঙ্গে না থেকে সব বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। তাদের সাফল্যকে অভিনন্দিত করতে হবে, এটাই স্মার্টনেস। মনে রাখতে হবে যে ব্যর্থতাকে মেনে নেওয়াটা একটি বিশেষ সামাজিক দক্ষতা। এই বিশেষ সামাজিক দক্ষতা হয়তো অনেক ভালো ফল করা ছাত্রের নেই। তাই ব্যর্থতাকে মেনে নেওয়ার অভ্যাস করতে থাকলে সামাজিকভাবে দক্ষ হতে পারবে।

পৃথিবীতে বহু সফল মানুষের উদাহরণ রয়েছে, যাঁরা সাময়িক ব্যর্থতাকে জয় করে বিশেষ যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতাগুলো মনে রাখতে হবে।

কোনো কারণে পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হলেও সন্তানের পাশে থাকুন। মডেল: দিনা আলম, ফাহিম ও নাসিম উদ্দিন আহমেদ। ছবি: সুমন ইউসুফ
কোনো কারণে পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হলেও সন্তানের পাশে থাকুন। মডেল: দিনা আলম, ফাহিম ও নাসিম উদ্দিন আহমেদ। ছবি: সুমন ইউসুফ

মা-বাবারা কী করতে পারেন
শিশুদের ছোটবেলা থেকেই ব্যর্থতাকে মেনে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। শিশু কোনো কাজে বা পড়ালেখায় ব্যর্থ হলে, আশানুরূপ ফল না করলে তাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করবেন না। তিরস্কার করবেন না।

তাকে উত্সাহ দিতে হবে। ‘তোমার দ্বারা হবে না’, ‘তুমি কিছু করতে পারবে না’—এই ধরনের কথা বলে শিশুকে নিরুত্সাহিত করলে সে হতাশ হয়ে পড়বে।

পড়ালেখাসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিশুদের অন্য কারও সঙ্গে তুলনা করবেন না। বিশেষ করে পরিবারের সমবয়সী সদস্যদের সঙ্গে কখনোই নয়। মা-বাবারা তাঁদের অপরাপর স্বজনদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে শিশুদের সে প্রতিযোগিতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন না। যেমন আপনার বোনের সন্তান জিপিএ-৫ পেয়েছে, আপনার সন্তান না পেলে আপনার মান থাকবে না, এই ভাবনা ঝেড়ে ফেলুন।

সন্তানকে কোনো বিষয়ে টার্গেট দেবেন না যেমন: ‘তোমাকে জিপিএ-৫ পেতেই হবে’, ‘তোমাকে ডাক্তার হতেই হবে’, ‘তোমাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতেই হবে’।

‘সময়টা প্রতিযোগিতার’, ‘ভালো রেজাল্ট না করলে কী করে হবে’, ‘সবাই তো ভালো ফল করে’,‘তুমি খারাপ রেজাল্ট করলে মুখ দেখাব কী করে’ বা ‘বাবা-মা কত শিক্ষিত, আর তোমার যদি এই হাল হয় কেমন হবে?’ এ-জাতীয় কথাবার্তা বলা যাবে না।

সন্তান কোনো পরীক্ষায় খারাপ ফল করলে সেটাকে মেনে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি পরীক্ষাই জীবনের সব নয়। খারাপ ফলের জন্য নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখালে তার ভবিষ্যৎ ফলাফল আরও খারাপ হবে।

অনেক সময় সন্তান নিজেই ভালো ফল করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে, আশানুরূপ ফল করতে না পারলে রাগ করে, কাঁদে, চিত্কার করে। অনেক মা-বাবা এটাতে পুলকিত হন, ‘আহা, আমার সন্তান কত্ত দায়িত্ববান, ফল খারাপ করে নিজেই দুঃখ পেয়েছে।’ কিন্তু এতে খুশি না হয়ে তাকে সান্ত্বনা দিন, বলুন, খারাপ ফল হতেই পারে। সে যেন ভেঙে না পড়ে, ভবিষ্যতের জন্য যেন সে প্রস্তুতি নেয়।

খারাপ ফলের পর সন্তানের মধ্যে চিন্তা আর আচরণের অস্বাভাবিকতা (যেমন একা থাকা, ঘুম না আসা, কান্নাকাটি করা, মৃত্যুচিন্তা করা, নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা ইত্যাদি) দেখা দিলে মনোচিকিত্সকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।

দায়িত্ব আছে শিক্ষকেরও
কেবল মা-বাবা নন, দায়িত্ব আছে শিক্ষকেরও। কেন একটি ছেলে খারাপ করছে, তা জানার চেষ্টা করতে হবে। তার কোনো পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সমস্যা আছে কি না, তা জানুন। পড়ালেখায় তার ঘাটতি থাকলে সেটাকে মিটিয়ে ফেলতে কী করতে হবে, সে পরামর্শ দিন।

শ্রেণিকক্ষে একজন দুর্বল শিক্ষার্থীকে কখনোই ব্যঙ্গ করা যাবে না। সবার মেধা সমান নয়, কিন্তু সবার মধ্যেই সক্ষমতা আছে। সেই সক্ষমতার জায়গাটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন।

একটি ছাত্র যখন বারবার অকৃতকার্য হতে থাকে, অথচ তার অতীত রেকর্ড ভালো, তখন শিক্ষা আর পরীক্ষাপদ্ধতির মধ্যে কোনো ত্রুটি আছে কি না, তা দেখার চেষ্টা করুন। পরীক্ষাপদ্ধতির ত্রুটির কারণে শিক্ষার্থী যেন কখনোই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

পরীক্ষার হলে এক বিষয়ের বদলে আরেক বিষয়ের প্রশ্ন যদি শিক্ষার্থীর হাতে চলে যায়, তখন যেন সব দায় সেই শিক্ষার্থীকে বহন করতে না হয়। যিনি প্রশ্নপত্র বিতরণ করছেন, যিনি ছাত্রের খাতায় স্বাক্ষর দিচ্ছেন, তাঁরও দায়িত্ব আছে। পরীক্ষক বা পরীক্ষা-সংশ্লিষ্ট কারও ত্রুটি হলে সেটা স্বীকার করে নেওয়ার সৎ সাহস শিক্ষকদের থাকতে হবে।

একজন দুর্বল ছাত্রের জন্য স্কুলের রেকর্ড খারাপ হবে, এই মনোবৃত্তি থেকে স্কুল কর্তৃপক্ষ আর শিক্ষকদের বের হয়ে আসতে হবে। স্কুলে বিভিন্ন পর্যায়ের মেধাবীরা পড়বে। সবাই যে এক হবে না, সেটা যেন কর্তৃপক্ষ ভুলে না যায়।