সারাহাহর পর স্টুলিশ!

>প্রতিটি মানুষের মধ্যেই আত্মপ্রেম আছে। আমরা অন্যের কাছে গুরুত্ব পেতে চাই। অন্যের মনোযোগ পেলে আমাদের ভালো লাগে। আমাকে নিয়ে একজন ভাবছেন—এটা ভেবে যিনি মেসেজটা লিখছেন এবং যিনি পড়ছেন, দুজনই আনন্দ পাচ্ছেন।


‘বস, নেতা হিসেবে আপনি একেবারেই ভালো নন। অযোগ্য লোকদের মাথায় তুলে রাখেন, আর যোগ্য লোকেরা আপনার চোখে পড়ে না।’
অফিসের বড় কর্তার মুখের ওপর একজন কর্মী কি এ কথা বলে দিতে পারেন? কেউ যদি পারেনও, তিনি নিশ্চয়ই অত্যধিক সাহসী কিংবা ততোধিক বোকা! বসকে নিশ্চিন্তে এ রকম একটা কিছু বলে ফেলার সুযোগ করে দিতে চেয়েছিলেন জাইন আল-আবিদিন তৌফিক। সৌদি আরবের এই অ্যাপ নির্মাতা গত বছর বাজারে এনেছিলেন একটি নতুন মোবাইল ফোন অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ), নাম সারাহাহ।
সারাহাহ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো সৎ বা অকপট। সহজ করে বললে, এটি একটি ‘বেনামী চিঠি’ পাঠানোর মাধ্যম। পরিচয় গোপন রেখে সারাহাহর ব্যবহারকারীকে ইচ্ছেমতো ‘মেসেজ’ (বার্তা) পাঠানো যায়। অ্যাপটির িনর্মাতার সোজাসাপ্টা বক্তব্য, অফিসের কর্মীরা যেন নির্ভয়ে বসকে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন, সে জন্যই এই অ্যাপ। এর মাধ্যমে মানুষ তাঁর শক্তি এবং দুর্বলতার দিকগুলো জানতে পারবেন।
জাইন আল-আবেদিনের তৈরি অ্যাপটির ব্যবহার বস আর কর্মীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। শুধু শক্তি আর দুর্বলতা নয়, সারাহাহর মাধ্যমে মানুষ প্রকাশ করেছে ভালো লাগা, ভালোবাসা, ঘৃণা, রাগ, বিরক্তি, এমনকি কামনাও। অ্যাপে জমা পড়া মেসেজগুলো মানুষ ফেসবুকে শেয়ার করেছে। সাদা খামের (সারাহাহর লোগো) পাশে বিচিত্র সব মেসেজের ছবিতে ভরে গেছে ফেসবুকের হোমপেজ।
গত বছর বাংলাদেশেও সারাহাহ তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বেধেছিল তর্ক। এক দল খুব বিরক্ত—এইসব বেনামী মেসেজ ফেসবুকে শেয়ার করার কী দরকার? আরেক দল বলছে, নতুন একটা ‘ট্রেন্ড’-এর সঙ্গে থাকলে ক্ষতি কী?

নতুন ট্রেন্ডটির অবশ্য পুরোনো হতে সময় লাগেনি। মানুষ দ্রুতই সারাহাহর প্রতি আগ্রহ হারিয়েছেন। অধিকাংশ লোক মোবাইল থেকে সারাহাহ মুছে ফেলে হাত ঝেড়েছেন।
সম্প্রতি, নতুন অ্যাপ্লিকেশন স্টুলিশ নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে। মোড়ক ভিন্ন, জিনিস এক। সারাহাহর লোগো ছিল সাদা খাম, আর স্টুলিশের লোগো সাদা পায়রা। ফেসবুকের নীল আকাশ (পড়ুন হোমপেজ) এখন সাদা পায়রায় ছেয়ে গেছে। গুগল প্লে স্টোরের র‍্যাঙ্কিংয়ে স্টুলিশ দ্রুতই সেরা দশে জায়গা করে নিয়েছে। অ্যাপটি তৈরি করেছে এইচএলএন এন্টারটেইনমেন্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
আচ্ছা, বেনামী চিঠি পেতে আমরা এত আগ্রহী কেন? এ প্রসঙ্গে আলাপ হলো জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকারের সঙ্গে। তিনি মনে করেন, সারাহাহ বা স্টুলিশে অধিকাংশ মানুষ আসলে বিশেষ কারও মেসেজের অপেক্ষায় থাকেন। সে হতে পারে পুরোনো প্রেমিক, প্রেমিকা বা কাঙ্ক্ষিত মানুষ। মনের কথাটা যিনি বলতে পারছেন না, আমরা তাঁকে একটা সুযোগ করে দিতে চাই। অথবা উল্টো করে বললে, আমরা তাঁর কথা শোনার একটা সুযোগ নিতে চাই!

মেখলা সরকার বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের মধ্যেই আত্মপ্রেম আছে। আমরা অন্যের কাছে গুরুত্ব পেতে চাই। অন্যের মনোযোগ পেলে আমাদের ভালো লাগে। আমাকে নিয়ে একজন ভাবছেন—এটা ভেবে যিনি মেসেজটা লিখছেন এবং যিনি পড়ছেন, দুজনই আনন্দ পাচ্ছেন।’

সব মেসেজে অবশ্য আনন্দিত হওয়া যায় না। বেনামীর সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ নোংরা মেসেজ লিখছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর শিকার নারীরা। মেখলা সরকার বলেন, ‘মেসেজের প্রেরক কে, সেটা যেহেতু আমি জানি না, তাই এসব মেসেজ গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। আমি মনে করি, এ রকম অ্যাপ ব্যবহার করে বরং অযথা সময় নষ্ট হয়।’
শুধু সময় নয়, ইন্টারনেটে আপনার নিরাপত্তাও নষ্ট হতে পারে এই ‘আচমকা জনপ্রিয় হওয়া’ অ্যাপের মাধ্যমে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব অ্যাপে তথ্য বেহাত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।