খেলা নিয়ে খোঁচা নয়

চলছে ফুটবল বিশ্বকাপ। প্রতিটি দলের রয়েছে ভক্তকুল। নিজের পছন্দের দল ভালো খেললে বা জিতলে ভক্তরা উল্লসিত হন। সেটাই স্বাভাবিক। আবার দেখা যায়, প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও দলের ভক্তদের নিয়ে প্রতিনিয়ত উপহাস-বিদ্রূপ করেন অনেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো এখন প্লাবিত প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ আর কটাক্ষে। শব্দবাণে জর্জরিত এদল-ওদলের ভক্তকুল।

বিশ্বকাপ ফুটবলের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে পুরো পৃথিবীকে একত্র করা, খেলার মানের উন্নয়ন এবং খেলা আয়োজনের মধ্য দিয়ে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ তৈরি করা। ফুটবল কোনো যুদ্ধ নয়, নয় বিদ্বেষ সৃষ্টির খেলা। এমনকি আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোতে গোল দেওয়ার পর যিনি গোল দিলেন, তাঁর অশালীন উচ্ছ্বাস আর অখেলোয়াড়সুলভ অঙ্গভঙ্গির জন্য লাল কার্ড পাওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে।

ফুটবল সম্প্রীতি আর ভালোবাসার খেলা। ঘৃণা তৈরির কোনো উপাদান এই খেলায় নেই! যদি খেলাটির গভীরে যাওয়া যায়, তাহলে বোঝা যাবে একটি বল (একই বিষয়) নিয়ে ১১ জন (একটি দল) একটি নির্ধারিত গোলপোস্টের (একই লক্ষ্য) দিকে ধাবমান হন। এখানে নির্দিষ্ট বিষয়ে মনঃসংযোগ করতে হয়, টিম ডেভেলপমেন্ট করতে হয় আর নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য সচেষ্ট হতে হয়। এর বাইরে আর কিছু নয়। কিন্তু এই খেলা নিয়ে যাঁরা উন্মত্ততায় জড়িয়ে পড়েন, প্রতিপক্ষের প্রতি কটাক্ষ করতে করতে শালীনতার সীমা অতিক্রম করে সভ্যতার সূচক কমিয়ে দেন, তাঁরা প্রকৃত পক্ষে খেলাটিকে ভালোবাসেন না, তাঁরা হিংসা আর কটাক্ষ চর্চা করে নিজের ইগোকে ডিফেন্স করেন মাত্র।

চারপাশে যখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের চর্চা, সবাই যখন তারস্বরে চিৎকার করছে ‘আমাকে দেখুন’ ‘আমাকে দেখুন’, তখন ফুটবল ‘আমাদের দেখুন’ বলে মানুষের ঐক্যকেই জানান দিতে চায়। আত্মকেন্দ্রিকতার বিপরীতে ফুটবল পারস্পরিক সহযোগিতা আর মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসার মেলবন্ধন! এই খেলায় একজন মেসি বা নেইমারের পেছনে থাকে হিগুয়েন বা মিরান্দা বা পাওলিনহো! কেউ খেলেন মধ্যমাঠে, কেউ খেলেন রক্ষণভাগে, কেউবা গোলপোস্ট আগলান। সবাই মিলেই একেকটি দল।
এটি এমন খেলা, যা মানুষকে কখনো দূরে ঠেলে দিতে শেখায় না। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উন্মত্ত ভক্তকুলের কটাক্ষের স্রোত কেবলই একজন থেকে আরেকজনকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে! সৃষ্টি হচ্ছে ঘৃণা আর বিদ্বেষ। ২০১০ সালে মিসরীয়-মার্কিন ব্লগার ইয়াসমিন ক্যাথেল বিশ্বব্যাংকের ‘ইউথিংক’ ব্লগ পাতায় তাঁর ‘ফুটবল কী করে বিশ্বকে বাঁচাতে পারে’ শীর্ষক ব্লগে লেখেন, ‘ফুটবল খেলা পরস্পরকে সংযুক্ত করে, টিমওয়ার্ক শেখায়, পরিশ্রমী করে, অন্যের ওপর বিশ্বাস আর নির্ভরতা বাড়ায়...আর সবচেয়ে বড় কথা শিশু আর কিশোরদের নেশা আর অপরাধ থেকে দূরে রাখে।’


ইয়াসমিন আরও বলেন, এই খেলার চর্চার মাধ্যমে ‘ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তন’ আনা সম্ভব। আরেকটি নিবন্ধে দেখা যায়, ইরানে নারী-পুরুষের লিঙ্গবৈষম্য নিরসনে ফুটবল খেলা একটি বড় প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছিল! ১৯৩০ সালে ইরানে নারীদের জন্য ফুটবল খেলা দেখা নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭০ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচে যখন ইরান খেলছিল, তখন এই খেলাকে কেন্দ্র করে ইরানি নারীদের একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং এরপর থেকে নারীদের জন্য ফুটবল খেলা উন্মুক্ত করা হয়। এখন ইরানের নিজস্ব নারী ফুটবল দলও রয়েছে!

ফুটবলের মতো একটি সর্বজনীন খেলাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটাক্ষ না করে, বিদ্বেষ আর ঘৃণা না ছড়িয়ে, খেলাটিকে উপভোগ করাই সভ্য মানুষের কাজ।



ফুটবল-ভক্তরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী করবেন আর কী করবেন না
মনে রাখবেন, আপনি যা নিয়ে পোস্ট দিচ্ছেন, সেটি একটি খেলা (ফুটবল), কিন্তু যেখানে পোস্ট দিচ্ছেন, সেটি (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) কোনো খেলার স্টেডিয়াম নয়। তাই আপনার যেকোনো খোঁচা, ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য আরেকজনের জন্য তীব্র মনোবেদনার কারণ হতে পারে।

ফান বা মজার সীমা বুঝতে শিখুন। এ জন্য আপনার প্রয়োজন কার্যকরী সামাজিক দক্ষতা, যা আপনি পরিবার, সমাজ আর অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করবেন।
নিজের পছন্দের দলকে অভিনন্দিত করার পাশাপাশি অন্য দলকেও ধন্যবাদ দিতে শিখুন। কারণ, সেই দলটি না থাকলে আপনার দল মূল্যহীন।
বাতাস বুঝে পাল তুলবেন না। আপনার লক্ষ্য, পছন্দ স্থির রাখুন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাহবা পেতে ‘মেকি ইমেজ’ তৈরি করবেন না। মনে রাখবেন, আপনার পক্ষ, প্রতিপক্ষ সবাই আপনাকে অনুসরণ করছে।
সমালোচনা খেলাকেন্দ্রিক থাকুক। খেলার বাইরের বিষয় নিয়ে বা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কোনো দলকে কটাক্ষ করবেন না।
আপনার পছন্দের দলের বাইরে অন্য দলগুলো খারাপ খেললে উচ্ছ্বসিত হবেন না, ব্যঙ্গ করবেন না।
আপনার দল ছাড়া অন্য দলগুলোও ভালো খেলতে পারে। সেই ভালো খেলার প্রশংসা করতে চেষ্টা করুন, তাতে আপনার পছন্দের দলের মানহানি হবে না।
আপনি যে দলকে সমর্থন করছেন, সেই দল বা সেই দলের যেকোনো খেলোয়াড় একটি ম্যাচে ভালো না-ও খেলতে পারেন। তাই বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশালীন ভাষা ব্যবহার কখনোই নয়।

কোনো খেলোয়াড়ের এমন কোনো বিকৃত ছবি পোস্ট করবেন না, যা আপনার নিজের ছবি হলে আপনি বিব্রত হতেন।
খেলা নিয়ে কারও সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হবেন না। খেলার কারণে কাউকে আনফ্রেন্ড বা ব্লক করার আগে একটু ভাবুন।
আপনি যদি ফুটবলকে ভালোবাসেন, তবে সেটি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে সেটিকে উপভোগ করার চেষ্টা করুন। আরেকজনের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে আর কটাক্ষ করে সময় নষ্ট করতে থাকলে খেলাই উপভোগ করতে পারবেন না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আপনার একটি ফ্রন্ট ডেস্ক, যা আপনার রুচি আর সভ্যতার পরিচয় বহন করে। খেলায় উন্মত্ত হয়ে, প্রতিপক্ষকে ব্যঙ্গ করতে গিয়ে নিজের রুচি আর সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না।

সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।