ইতি, তোমার অন্তর্মুখী বন্ধু

অন্তর্মুখীদের মুখ বন্ধ থাকে। কারণ মনের মধ্যে ভাবনার ডালপালা ছড়াতে থাকে। ছবি: কবির হোসেন
অন্তর্মুখীদের মুখ বন্ধ থাকে। কারণ মনের মধ্যে ভাবনার ডালপালা ছড়াতে থাকে। ছবি: কবির হোসেন
>একসঙ্গে অনেক মানুষের সান্নিধ্য আমরা ঠিক উপভোগ করি না। আবার কাউকে ভালো লাগার আগে তাকে জানতে আমাদের বেশ সময় লেগে যায়। কাউকে ভালো লাগলে আমরা সহসা তা প্রকাশও করি না। সুতরাং, একটু সহনশীল তো আপনাকে হতেই হবে। শ্রোতা হিসেবে আমরা প্রথম শ্রেণির। তবে আমরা তা-ই শুনি, যা শুনতে চাই। তাই কোনো কিছুতে আগ্রহ প্রকাশ না করলে, কানের কাছে মশার ভূমিকায় অবতীর্ণ না হওয়ায় ভালো।

 

দুটো কারণে বাড়িওয়ালা আমাকে খুব পছন্দ করেন। প্রথমত আমার শান্ত স্বভাব। ‘হইচই স্বভাবের ভাড়াটিয়া চাই’ লিখে কোনো বাড়িওয়ালা বিজ্ঞপ্তি দেন না।
দ্বিতীয়ত চাইবার আগেই আমি গিয়ে ভাড়া দিয়ে আসি। বাড়িওয়ালা নিশ্চয় ভাবেন, বাহ্‌ কী ভালো ছেলে! সেটি তিনি ভুল ভাবেন না। তবে ভাড়া চাইতে তিনি যেন যখন-তখন না আসেন, সেটাই আমার চাওয়া।
বাড়িওয়ালাকে আমি অপছন্দ করি, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে আমার একাকী ভাবনার জগতের ছন্দপতন হোক, এমন কোনো কিছুই আমি চাই না। এ জন্য অনেকে আমাকে অন্তর্মুখী বলেন, ইংরেজিতে ইনট্রোভার্ট বলেন। কে জানে কেউ কেউ হয়তো গোঁয়ারও বলে থাকেন। যে যা-ই বলুক, সামাজিকতার প্রচলিত মাপকাঠিতে মাপার জন্য নিজেকে আমি বদলাতে পারি না।

অবশ্য কথা কম বলার জন্য লোকে বেশির ভাগ সময়েই আমাকে লাজুক হিসেবে আখ্যা দেন। তাঁরা জানেন না, অন্তর্মুখীদের মুখ বন্ধ থাকে কারণ আমাদের ভাবনার ডালপালা ছড়াতে থাকে। সেখানে নতুন নতুন ধারণা তৈরি হয়। মস্তিষ্কের কোষগুলোর মধ্যে সে ধারণাগুলো যেন রেসের ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকে। মুখ ফুটে বলতে গেলে প্রায়ই আমাদের মনে হয়, নিশ্চয়ই অদ্ভুত শোনাবে। ফলাফল, তুমুল কোনো আড্ডা বা সিরিয়াস কোনো আলোচনায় আমাদের ভূমিকা ছোট্ট এক টুকরো হাসি।

সেই হাসি আমাদের ‘লাজুক’ ভাবমূর্তিতে কোনো পরিবর্তন আনে না। আর তাই আমরা যখন হুটহাট চরম কোনো ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য ছুড়ে দিই, সবাই একদম থ মেরে যান। কিন্তু সেও আমাদের ভাবনার বিশাল বরফখণ্ডের চূড়ামাত্র। সে যা-হোক, এভাবে চলতে চলতে আমাদের মাঝে কীভাবে যেন দুটি সত্ত্বা তৈরি হয়ে যায়। প্রথমটা আমাদের লাজুক মূর্তি। আর দ্বিতীয়টা ‘আসল’ আমি। এই আমিকে শুধু কাছের মানুষেরাই চেনেন। এই আমি আর দশটা মানুষের মতোই কথার তুবড়ি ফোটায়, হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠে।

সবচেয়ে বাকপটু মানুষটা সম্পর্কে জানতেও অনেক সময় লেগে যায়। আর একজন অন্তর্মুখীকে বুঝতে চেষ্টা করা আরও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সময়ের সেই বিনিয়োগ হয়তো আপনার জীবনের সেরা বিনিয়োগ হয়ে উঠতে পারে। একজন অন্তর্মুখী মানুষের সঙ্গে কেমন আচরণ করা যেতে পারে, তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। প্রত্যেকেই আলাদা।
একজন মানুষ অন্তর্মুখী না বহির্মুখী, তা বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো সে কিসে সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ, তা জানা। অন্তর্মুখীরা একাকী সময় কাটাতে ভালোবাসে। তার মানে এই না যে তারা অসামাজিক। একসঙ্গে অনেক মানুষের সান্নিধ্য আমরা ঠিক উপভোগ করি না। আবার কাউকে ভালো লাগার আগে তাকে জানতে আমাদের বেশ সময় লেগে যায়। কাউকে ভালো লাগলে আমরা সহসা তা প্রকাশও করি না। সুতরাং, একটু সহনশীল তো আপনাকে হতেই হবে।

শ্রোতা হিসেবে আমরা প্রথম শ্রেণির। তবে আমরা তা-ই শুনি, যা শুনতে চাই। তাই কোনো কিছুতে আগ্রহ প্রকাশ না করলে, কানের কাছে মশার ভূমিকায় অবতীর্ণ না হওয়ায় ভালো।
অন্তর্মুখীরা কিন্তু নিরস নন। তারা আনন্দ করে, তা প্রকাশও করে, কখনো কখনো তো পাগলামিও করে বসে। তবে শুধু বিশেষ মানুষদের কাছে, বিশেষ সময়ে।
আমরা জীবনের গভীর অর্থ খোঁজার চেষ্টা করি। এমন অনেক কিছুই আমরা বিশ্লেষণ করি, যা আপাতদৃষ্টিতে একদম সরল মনে হয়। কোনো কিছু বুঝতে বেশি সময় নিচ্ছি মানে আমরা বোকা না, বরং আমরা মলাট উলটে পুরো বই খুঁটিয়ে দেখছি। আমার বন্ধু হতে চাইলে আপনার সে ধৈর্য থাকতে হবে। হয়তো সে কারণেই গুটি কয়েক কাছের মানুষ নিয়েই আমরা জীবনটা কাটিয়ে দিই।
আমার অন্তর্মুখী স্বভাব আমি বেশ উপভোগ করি। তবে মাঝেমধ্যে বহির্মুখী হতেও ইচ্ছে করে। তবে কনসার্টে গিয়ে সবার মতো মাথা ঝাঁকিয়ে যখন গান উপভোগ করতে ইচ্ছে হয়, তখন ভাবি এক মজলিশ লোক বুঝি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আবার পছন্দের মানুষকে মনের কথা বলতেও আমাদের যত সংকোচ। তখন মনে হয়, সে কেন এগিয়ে আসছে না! এটা যে একটা ইঙ্গিত, তা কি বলে দিতে হবে?
বেশির ভাগ অন্তর্মুখী মানুষ মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতে পছন্দ করেন না। ভরা মজলিশে ভাষণ দেওয়া তাদের কাছে সাঁতরে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার মতোই কঠিন। এর চেয়ে আমরা বরং কোনো বিষয়ে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পছন্দ করি। তবে সে বিষয়ে আমাদেরও যে একটা মতাদর্শ আছে, তা ভুলে যাবেন না।

সব ছুটির দিনে বাইরে যাওয়া না-ও ভালো লাগতে পারে। এর চেয়ে বরং বই নিয়ে কিংবা ঘরে সিনেমা দেখতে দেখতে সময় কাটিয়ে দেওয়া বেশি উপভোগ্য মনে হতে পারে। তাই আপনার অন্তর্মুখী বন্ধু যদি কম জায়গায় বেশি মানুষের উপস্থিতে হাঁসফাঁস বোধ করে, তবে তাকে এমন কোনো অনুষ্ঠানে যেতে পিড়াপীড়ি করার দরকার কি?
কর্মস্থলে ছোট দলে কাজ করা আমাদের জন্য বেশি সুবিধার। এতে আমরা কাজটাও ভালো করতে পারি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারও তা বোঝা উচিত। এখন কিছু মাথায় রেখে অন্তর্মুখীদের কেন কাজে নিয়োগ দেবেন? কারণ তারা এমন অনেক বিষয় খুঁটিয়ে দেখে, এমন অনেক সমস্যার সহজ সমাধান দিয়ে থাকে, যা হয়তো অন্যরা এড়িয়ে যায়। আর গবেষণা বলে, অন্তর্মুখীরাও ভালো নেতা হতে পারে। কারণ তাদের দূরদৃষ্টি ভালো, আর নিজেকে অন্যের জায়গায় রেখে ভাবতেও তাদের জুড়ি নেই।

সবশেষে বলতে চাই, আমরা অন্তর্মুখী মানুষ না। আমরা মানুষ, যারা স্বভাবে কিছুটা অন্তর্মুখী। এই শব্দটি আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কেবল একটা দিকই তুলে ধরে, এর বেশি না। দয়া করে, আমাদের ভিনগ্রহের প্রাণী ভেবে আলাদা শ্রেণিতে ফেলতে যাবেন না।