শৈশব ও কৈশোরকালীন বাতের সমস্যা

অলংকরণ : শামীম  আহমেদ
অলংকরণ : শামীম আহমেদ

বাতের কারণে কষ্ট পাবার কথা উঠলে প্রথমেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে লাঠি হাতে বয়স্ক কোনো ব্যক্তির ছবি। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে এই বাত শিশু এবং কিশোর বয়সেও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি লাখে প্রায় ৯৪ জন শিশু বা কিশোর বাতের সমস্যায় ভুগছে। ১৬ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে কারও যদি এক বা একাধিক অস্থিসন্ধিতে ৬ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ব্যথা, ফুলে যাওয়া এবং সেই সঙ্গে অস্থিসন্ধি শক্ত হয়ে নড়াচড়া কমে যাওয়ার ইতিহাস থাকে, তবে এই অবস্থাকে শৈশব–কৈশোরকালীন বাত বা ডাক্তারি ভাষায় জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস বলা হবে। প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে এই অসুখটি থেমে না থেকে বরং বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রোগীর বাকি জীবনের সঙ্গী হিসেবে থেকে যেতে পারে। একটি কথা মনে রাখা দরকার যে এই অসুখটিকে বাতজ্বরের সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে কিন্তু চলবে না। বাতজ্বর বা রিউম্যাটিক ফিভার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি অসুখ।

এই অসুখের অবশ্য বেশ কয়েকটি রকমফের পরিলক্ষিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই বাত শুধু এক বা উভয় হাঁটুতে, আবার অনেক সময় হাত বা পায়ের আঙুল, মনিবন্ধ, গোড়ালিসহ অন্য অস্থিসন্ধিগুলোতেও দেখা দিতে পারে। অনেকের আবার চোখের মণিতে প্রদাহ এবং কোমর শক্ত হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থারও সৃষ্টি হতে পারে। অসুখটির প্রকার ভেদে জ্বর, ত্বকে ছোট ছোট ফুসকুড়ি ওঠা, গলা বা অন্য কোনো স্থানের গ্ল্যান্ড ফুলে যাওয়া, লিভার অথবা প্লিহা বড় হয়ে যাওয়াসহ অন্যান্য সমস্যাও দেখা দিতে পারে। কিছু শিশুর ক্ষেত্রে শারীরিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে দেখা যায়, এমনকি সময়মতো চিকিৎসা না করালে শিশুটি পঙ্গু হয়ে পড়তে পারে। তারা অন্য শিশুদের মতো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা এবং খেলাধুলা করতে না পারার কারণে হীনমন্যতাসহ নানা ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বৈকল্যের শিকার হয়ে পড়তে পারে।

সঠিক কারণটি জানা না গেলেও ধারণা করা হয় যে শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাতে একধরনের ত্রুটির কারণে এই অসুখটির সূচনা হয়। প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রধান কাজই হচ্ছে জীবাণু বা অন্য কোনো বহিরাগত শত্রুকে অনুপ্রবেশে বাধা দেওয়া। এই অসুখকে শরীরের এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থাটি ভুলবশত অস্থিসন্ধিকেই আক্রমণ করে বসে যার ফলে সেখানে প্রদাহের সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীতে যা বাত আকারে ধরা দেয়। অনেক সময় অসুখটি একই পরিবারের একাধিক মানুষকে আক্রান্ত করে থাকে।

এই রোগটি সঠিকভাবে শনাক্ত করা এবং সেই অনুযায়ী উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদানের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ রিউম্যাটোলস্টি বা বাতরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অপরিহার্য। রোগটি নির্ণয়ের জন্য কিছু রক্ত পরীক্ষা এবং প্রয়োজনে আক্রান্ত অস্থিসন্ধির এক্স-রেসহ আরও কিছু পরীক্ষা করা যেতে পারে।

আজকাল এই অসুখের ভালো চিকিৎসা রয়েছে। বর্তমানে বাজারে অনেক ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ পাওয়া যায়, যাদের কল্যাণে তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই একজন রোগী অনেক দিন ধরেই এই ওষুধগুলো সেবন করতে পারে। আক্রান্ত অস্থিসন্ধিতে ইনজেকশনের মাধ্যমে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করে দীর্ঘমেয়াদি সুফল অর্জন করা সম্ভব। মেথোটেক্সেট জাতীয় ওষুধের দ্বারা অস্থিসন্ধির ক্ষয় রোধের মাধ্যমেও যথেষ্ট সুফল পাওয়া যায়। এ ছাড়া, বর্তমানে মানব দেহ থেকে সরাসরি কিছু প্রদাহ নিরোধক পদার্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে, যেগুলো আধুনিক চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে।

এ কথা ঠিক যে শুধু কিছু ওষুধ প্রয়োগ করেই সব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এর পাশাপাশি ফিজিওথেরাপিস্ট এবং অকুপেশনাল থেরাপিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট ব্যায়ামের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অনেক সময় হৃত মনোবল ফিরে পেতে মনোবিজ্ঞানীর সহায়তা এবং চোখ ও দাঁতের জন্য বিশেষ চিকিৎসা নিতে হতে পারে। তবে এতসব সুযোগ-সুবিধা একসঙ্গে পাওয়া দুষ্কর বিধায় উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই বাতের সমস্যা নিরসনে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে কিছু ইনস্টিটিউট এবং সামাজিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। সময় এসেছে আমাদের দেশেও এই ধরনের সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করা, যাতে করে এসব শিশু-কিশোরকে স্বাভাবিক জীবনে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারি।

লেখক: বিশেষজ্ঞ, ইন্টারনাল মেডিসিন অ্যান্ড রিউমোটোলজি ফর অ্যাডাল্ট অ্যান্ড চাইল্ড।