যত্রতত্র হর্নে বাড়ছে নানা রোগ

অফিস শেষে নিয়মিত রিকশায় বাসায় ফেরেন আরাফাত পারভেজ। প্রধান সড়ক ছেড়ে এলাকায় প্রবেশ করতে উচ্চ শব্দের হর্ন তার কানে এল। রিকশাচালককে রাস্তার ধার ঘেঁষে চালাতে অনুরোধ করলেন। দেখলেন, একটা মোটরসাইকেল শাঁই করে চলে গেল। পেছনে ফিরে দেখলেন, আর কোনো গাড়ি নেই। দুই চাকার বাহনে ট্রাকের হর্ন! 

 আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অথবা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বাজিয়ে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির দেখাও মেলে। ছোটখাটো সেডান গাড়িতেও হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার হয়। যদিও মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুযায়ী কোনো গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন সংযোজিত পাওয়া গেলে জরিমানার বিধান আছে। তবে জরিমানার অঙ্ক মাত্র ১০০ টাকা! 

 কোন গাড়িতে কী হর্ন ব্যবহার করতে হবে, এ ধরনের কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। তবে গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্টক হর্ন (যেটা গাড়ির সঙ্গে থাকে) ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকে। বাজারে অনেক ধরনের হর্ন পাওয়া যায়। সাধারণ শব্দের হর্নগুলোতে কোনো গাড়িকে আলাদা করে শনাক্ত করার সুযোগ নেই। সেডান গাড়িগুলোতে ‘পিপ পিপ’ শব্দের হর্ন আর এসইউভি অথবা বাণিজ্যিক গাড়িতে ‘পপ পপ’ শব্দের হর্ন ব্যবহৃত হয়। কিছু হর্ন রয়েছে যেগুলো বেশ কিছুক্ষণ ধরে শব্দ উৎপাদন করে। দূরের রাস্তায় উচ্চ শব্দের হর্ন থাকলে দূর থেকেই পথচারী বা অন্যান্য গাড়িকে সতর্ক করা যায়। কিন্তু শহরের মধ্যে এই শব্দগুলো শ্রবণকারীর জন্য কষ্টকর। 

 মোটরসাইকেলে যে হর্ন বাজানো হয়, তা অপেক্ষাকৃতভাবে গাড়ির শব্দের চেয়ে কম ডেসিবেল (ডিবি) সমৃদ্ধ। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, একজন সুস্থ মানুষ ২০ থেকে ২০,০০০ স্পন্দনের শব্দ শুনতে পারে। মানুষের শব্দ গ্রহণের স্বাভাবিক মাত্রা ৪০-৫০ ডিবি পর্যন্ত। এমন অনেক হর্ন রয়েছে, যে হর্নগুলো ৬০ ডিবি থেকে শুরু করে ১২০ ডিবি পর্যন্ত শব্দ উৎপন্ন করে। সাধারণত ৬০ ডিবি শব্দ মানুষকে সাময়িকভাবে এবং ১০০ ডিবি শব্দ সম্পূর্ণ বধিরতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই এ ধরনের হর্ন শব্দদূষণের এবং স্বাস্থ্যহানির অন্যতম কারণ। 

 বেশির ভাগ গাড়িতে দ্বৈত হর্ন ব্যবহৃত হয়। গাড়ির বাঁ এবং ডান দিকে এই হর্নগুলোর মুখ ঘোরানো থাকে। এ ছাড়া একটা হর্ন কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেলে অন্য হর্নকে বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। মোটরসাইকেলে একটি হর্ন থাকে। বাইকের সামনে চেসিসের সঙ্গে হর্ন লাগানো থাকে। এতে সামনের দিক থেকে শব্দ উৎপন্ন হয়। এ ছাড়া বাণিজ্যিক গাড়িগুলোতে (বাস, ট্রাক, টেম্পো) সেডান গাড়ির চেয়ে বেশি ডিবির হর্ন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সংযুক্ত করে দেয়। বড় গাড়িতে বেশি জায়গার প্রয়োজন হয়। তাই উচ্চ শব্দ অন্য গাড়ির চালককে সেই গাড়ির আকার সম্পর্কে ধারণা দেয়। এতে সাইড নেওয়া বা দেওয়ার জন্য শব্দের ওপর ভিত্তি করে চালকেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এ ছাড়া বাড়তি সতর্কতার জন্য সাইড মিরর তো আছেই। 

 মোটরসাইকেল বা গাড়িতে যত্রতত্র হর্ন লাগিয়ে শব্দদূষণ করার অভিযোগের কথা অহরহ শোনা যায়। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধের জন্য নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্ট মো. রাজীব হোসেন মিয়া বলেন, ‘হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের ওপর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ ছাড়া বিকট শব্দ অথবা জনসাধারণের অসুবিধা সৃষ্টিকারী কোনো যন্ত্র যদি মোটরসাইকেল বা গাড়িতে যুক্ত করা হয়, সে ক্ষেত্রে আমরা আদেশ অমান্যের (ধারা ১৪০) অপরাধে মামলা করতে পারি। মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিআরটিএর অনুমতি ছাড়া গাড়ির উল্লিখিত কিছু অংশ পরিবর্তন করা যাবে না। হর্নকে এই খাতে ফেলেও জরিমানা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। মোটরসাইকেল বা গাড়িতে কী হর্ন যুক্ত রয়েছে, তা শব্দ সৃষ্টি না করা পর্যন্ত বোঝার উপায় নেই। মাঝেমধ্যে আমরা হর্ন বাজিয়েও কী হর্ন লাগানো রয়েছে, তা পরীক্ষা করে দেখি।’ 

 মোটরসাইকেলের জন্য যে হর্ন বা সেডান গাড়ির জন্য সাধারণ যে হর্ন ব্যবহার করা হয়, তা গাড়িতে ব্যবহার করাই উত্তম। এতে শব্দদূষণ কম হয় এবং চালকও সহজে সতর্ক হতে পারেন। অটোমোবাইল বাজারে বিভিন্ন দেশের হর্ন পাওয়া যায়। ৫০০ থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকার মধ্যে এই হর্নগুলোর মূল্য হয়ে থাকে। চীন, ইতালি, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের হর্ন বাজারে সহজলভ্য। হর্ন আমদানির কোনো নীতিমালা না থাকায় বিকট শব্দের হর্নগুলো হরহামেশায় বিক্রি হয়ে থাকে। 

বিকট শব্দে হর্ন বাজালে কী ক্ষতি হতে পারে? চোখ, কান ও গলাবিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘বিকট শব্দ সুস্থ মানুষের জন্য তো বটেই, শিশু, শিক্ষার্থী এবং রোগীদের জন্য ভয়ানক। এর কারণে মানুষ বধিরতার মতো রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ ছাড়া হঠাৎ হর্ন বাজানোর ফলে মানুষের মনে ভীতির সৃষ্টি হয়। এই ভীতি মানসিক রোগের কারণ হতে পারে। 

 বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্কুটার বা মোটরসাইকেলের হর্ন ৮৭ থেকে ৯২ ডিবি এবং ট্রাক-বাস ৯২ থেকে ৯৪ ডিবি শব্দ সৃষ্টি করে। শব্দের বাঞ্ছনীয় মাত্রা রয়েছে, যা ব্যক্তিগত কক্ষে ২৫ ডিবি, ড্রয়িং বা ডাইনিং কক্ষে ৪০ ডিবি, অফিসে ৩৫-৪০ ডিবি, শ্রেণিকক্ষে ৩০-৪০ ডিবি, গ্রন্থাগারে ৩৫-৪০ ডিবি, হাসপাতালে ২০-৩৫ ডিবি, রেস্তোরাঁয় ৪০-৬০ ডিবি এবং রাত্রিকালে শহর এলাকায় ৪৫ ডিবি। শব্দ এই সীমা অতিক্রম করলে শব্দদূষণের সৃষ্টি হয়। সীমার বাইরের শব্দদূষণ শ্রবণক্ষমতা নষ্ট করে। এর ফলে মানসিক ভারসাম্যও বিনষ্ট হতে পারে। শব্দদূষণ খিটখিটে মেজাজ সৃষ্টিরও কারণ। এর দ্বারা ফুসফুস আক্রান্ত হয়, শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বাধাগ্রস্ত হয় এবং তাদের লেখাপড়ায় উদাসীন করে তোলে। 

 মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতিমধ্যে দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্​রোগসহ, ফুসফুসজনিত জটিলতা, মস্তিষ্কবিকৃতি, স্মরণশক্তি হ্রাস, মানসিক চাপসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা। ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের গত ছয় মাসে ট্রাফিক পুলিশ ১৮ হাজার ৫২২টি হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করেছে। এ সময় ১০ লাখ ২২ হাজার ৩৩৮টি মামলা হয়েছে। 

অযথা হর্ন বাজানোর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ‘হর্ন হুদাই...’ প্রচারণা নিয়ে একটি পেজও রয়েছে। চার বছর আগে থেকে এককভাবে এই আন্দোলন শুরু করেন গ্রাফিক ডিজাইনার মমিনুর রহমান। ডিএমপি অযথা হর্ন না বাজাতে কয়েকটি জনসংযোগও করেছে। মানুষের ক্ষতি হয়, এমন হর্ন ব্যবহার বন্ধ হওয়া উচিত। যে গাড়িতে যে হর্ন মানানসই, সে হর্ন ব্যবহার করলে অন্য গাড়ি বা মানুষের জন্য নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন করা সহজ হবে। এ ক্ষেত্রে গাড়ির চালকের পাশাপাশি গাড়ির মালিকদেরও সতর্ক হওয়া উচিত।