দেখেছি ক্যানসারের সঙ্গে মায়ের লড়াই

>অক্টোবর স্তন ক্যানসার-সচেতনতার মাস। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে ক্যানসার নিরাময়যোগ্য। তবে আমাদের সমাজে ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষকে এখনো রোগের পাশাপাশি লড়াই করতে হয় সমাজের সঙ্গে। এ সময়ে খুব প্রয়োজন কাছের মানুষের সহযোগিতা। সেটা পেলে লড়াইটা হয় সহজ। জয় করা যায় ক্যানসার। ক্যানসারের সঙ্গে বসবাসের গল্প নিয়ে এই আয়োজন।
ছবিটি প্রতীকী। মডেল: জিনিয়া। ছবি: অধুনা
ছবিটি প্রতীকী। মডেল: জিনিয়া। ছবি: অধুনা

আমার নানি ১৯৬৬ সালে ৪৫ বছর বয়সে ক্যানসারে মারা যান। রেখে যান সাত কন্যা ও পাঁচ ছেলে। আমার মা সামসুন্নাহার রহমান তাঁর বড় সন্তান। কাছের মানুষদের কাছে মা পরান নামে পরিচিত ছিলেন। স্বভাবতই তাঁকে ছোট ছোট ভাইবোনের জন্য মায়ের ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। তাঁর সবার ছোট বোনটি জিনিয়া মাত্র ছয় বছর বয়সী ছিলেন। নানির মৃত্যুর কারণ কার্সিনোমা হওয়াতে ছোট থেকেই দেখেছি আম্মা ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য অতিসচেতন। সব সময় খেয়াল করেছি, তিনি খাদ্যতালিকায় সবজি, বিশেষ করে টমেটো, গাজর, পেঁপে, নিমপাতা, নিমের বড়ি ইত্যাদি খেতেন। ওজন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।

একসময় তাঁর স্তনে সিস্ট ধরা পড়ে। তখন বাংলাদেশে ম্যামোগ্রাম, সনোগ্রাম, এসব চিকিৎসার সুবিধা প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। আম্মা চট্টগ্রামে বসবাস করতেন এবং চট্টগ্রামে সমাজ উন্নয়নে ছিলেন পথিকৃতদের একজন। সেখানে ঘাসফুল নামে একটি উন্নয়নমূলক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর নারীদের জন্যও কাজ করেছেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৮ সালে স্বাস্থ্য কর্মসূচির মাধ্যমে ঘাসফুলের আবির্ভাব। 

কাজের সূত্রে তাঁকে দেশের বাইরে যেতে হতো। তিনি সব সময় বিদেশে নিয়মিত চেকআপ করাতেন। দেশেও ফলোআপ করা হতো। বড় সন্তান হিসেবে আমি আম্মার খেয়াল রাখতাম। কিন্তু বিধিবাম, ১৯৯৫ সালে শেষের দিকে চট্টগ্রামে টেলিফোনে আম্মার খোঁজখবর নিতে ফোন করে জানতে পারলাম, ওনার বুকের লাম্পটা বেশ বড় হয়েছে। থেকে থেকে ব্যথা অনুভব করছেন। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল, চিন্তিত হলাম। ওনাকে দেরি না করে তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে আসতে বললাম। খেয়াল করে দেখলাম, গত এক বছর ব্যস্ততায় ফলোআপ করা হয়নি এবং আমিও খেয়াল করিনি। 

উনি ঢাকায় এলেন ধানমন্ডিতে ম্যামোগ্রাম, সনোগ্রাম, রক্ত পরীক্ষা—সব করা হলো। সন্ধ্যার সময় বনানীতে চিকিৎসক চৌধুরী হাবিবুর রহমানের কাছে নিয়ে গেলাম। আম্মা যখন কাপড় সরাচ্ছেন চেকআপের জন্য, উনি দূর থেকেই আমাকে আস্তে আস্তে বললেন, স্তনের ত্বক কমলার খোসার মতো ফুটো ফুটো হয়েছে ‘আরলি স্টেজ অব ক্যানসার’। ডাক্তার পরীক্ষা করে আমাকে বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ম্যাসটেকটমি অপারেশন করে বাঁ স্তনটি অপসারণ করে ফেলতে হবে। 

মা সামসুন্নাহার রহমানের সঙ্গে মেয়ে পারভীন মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত
মা সামসুন্নাহার রহমানের সঙ্গে মেয়ে পারভীন মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত

অপারেশন দেশে করাব না বিদেশে, চিন্তা করছিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, দেশেই করাব। আম্মাকে ক্যানসারের কথা বলিনি। তাঁকে বললাম, সহসা অপারেশন করতে হবে। মানসিক প্রস্তুতির জন্য এক দিন সময় দিলাম। ধানমন্ডির ডেল্​টা হাসপাতালে অপারেশন চলাকালীন ফ্রোজেন টেস্ট করে তাৎক্ষণিকভাবে বলা হলো, ক্যানসার। আম্মা বিষয়টি জানতেন না। তিনি অপারেশনের পরে উৎফুল্ল ছিলেন। ভাবলেন, এই যাত্রায় বেঁচে গেলেন। শুধু নিকটাত্মীয় কয়েকজন ছাড়া কাউকে ক্যানসারের বিষয়ে বলা হলো না।

আম্মার সব সময় ক্যানসারের আতঙ্ক ছিল। কয়েক দিন পর চিকিৎসক মোকাররম ধীরে ধীরে আম্মাকে বললেন যে তাঁর ক্যানসার হয়েছে। আম্মা শুধু বললেন, ‘শেষ রক্ষা হলো না!’ চিকিৎসক জানালেন, অনকোলজিস্টদের সঙ্গে পর্যালোচনা করে পরবর্তী চিকিৎসার পরিকল্পনা করবেন। চিকিৎসক মোকাররম একটা উপদেশ দিয়েছেন, নিজের পরিবেশে থাকতে পারলে রোগীর জন্য ভালো। ডেল্​টা হাসপাতালে চিকিৎসক পারভীন বানুর কাছে গেলাম এবং দেশেই চিকিৎসা করাব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। 

ডেল্​টা হাসপাতালে যখন আম্মার চিকিৎসা শুরু হয়, তখন তাঁর ফুফাতো বোন আমার ফটিক খালারও স্তন ক্যানসারের শেষ পর্যায়ে চিকিৎসা চলছিল এবং তিনি মারা গেলেন। আমার কাজিনরা বলল, ‘তোমরা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছ, দেশে চিকিৎসা করার।’ ওরা কলকাতায় চিকিৎসা করিয়েছে অনেক দিন। বিদেশে বাড়ির পরিবেশ থেকে দূরে, জনবলের অভাব, আর্থিক বিষয় সব মিলিয়ে একেক সময় দিশেহারা হতে হয়েছে তাদের। 

আম্মাকে ৬ সাইকেল কেমো এবং ২৫ সাইকেল রেডিয়েশন দিতে হয়েছে। ক্রমশ আম্মা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে গেলেন। তাঁর মতো আত্মপ্রত্যয়ী মানুষও মাঝেমধ্যে ভাবলেশহীন থাকতেন। আত্মবিশ্বাসও কমে গেল। নিজে নিজে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সাহস হারিয়ে ফেললেন। মনে হতো যেন মৃত্যুপথযাত্রী। 

আমি রাগ করতাম, বোঝাতাম, ‘তুমি তো এখনই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়বে না। তোমার চিকিৎসা হবে, সুস্থ হবে, আবার কাজের জগতে ফিরে যাবে।’ যখন চিকিৎসকের কাছে যেতাম, আমাকে বাচ্চাদের মতো আম্মা বলতেন, ‘আমি আমার মাকে দেখাশোনা করেছি, তুই–ও আমার দেখাশোনা করছিস।’ 

একসময় তিনি মৃত্যুচিন্তা থেকে মুক্ত হলেন। কারণ, তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে চিকিৎসকদের ওপর ভরসা জন্মাল। চিকিৎসক মোকাররম আশ্বস্ত করেছিলেন সাধ্যমতো চেষ্টা করার। সেই কথা তাঁরা রেখেছিলেন। তিনি, চিকিৎসক পারভীন বানুসহ চিকিৎসক বকুল ও অন্যরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আম্মার খুব কাছের মানুষ হয়ে গেলেন। এখনো যেটা রয়ে গেছে আমার সঙ্গে। 

আম্মা খুবই ভাগ্যবান। এত দীর্ঘ চিকিৎসার সময় প্রতি কেমোর সময় আমার মামা-খালারা, তাঁদের ছেলেমেয়ে কেউ না–কেউ উপস্থিত থাকতেন। আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী, বন্ধুদের একটি বিরাট ভূমিকা দেখেছি। ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষকে ভালো রাখার জন্য, তার আশপাশের মানুষদের তাকে বুঝতে হবে, ভরসা দিতে হবে, সে ভালো হবেই। 

বাধা পেরিয়ে জীবন যাবে এগিয়ে। প্রতীকী ছবিটির মডেল হয়েছেন হিরা। ছবি: কবির হোসেন
বাধা পেরিয়ে জীবন যাবে এগিয়ে। প্রতীকী ছবিটির মডেল হয়েছেন হিরা। ছবি: কবির হোসেন

সাইকেল অব ট্রিটমেন্ট সম্পন্ন হওয়ার পর আম্মার সময় হলো চট্টগ্রাম নিজের বাসায়, নিজের কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার। কিন্তু দেখলাম তাঁর সাহস নেই, মনোবল নেই। নিজেকে রোগী ভাবছেন। আশা করছেন আমাদের নিয়ে যেতে হবে, একা যেতে পারবেন না। যে মানুষ অহরহ চট্টগ্রাম-ঢাকা-চট্টগ্রাম ডে-ট্রিপ করতেন সেই মানুষের এই অবস্থা। আমি গিয়ে ওনাকে রেখে আসতে পারতাম। কিন্তু আমরা চিন্তা করলাম, ওনার আত্মবিশ্বাস আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। বললাম, ‘তুমি নিজেই সব করতে পারবে, একা যেতে পারবে।’ অনেক বোঝাতে হলো, তারপর একাই গেলেন চট্টগ্রামে। 

ঘাসফুলে ফিরে, তিনি সচল ও প্রাণবন্ত হলেন। তাঁকে পরবর্তী সময়ে সিঙ্গাপুর, বোম্বে টাটা মেমোরিয়ালে রেগুলার চেকআপ করানো হয়েছে। টাটাতে একটি অপারেশনও করতে হয়েছিল। পরে ব্যাংককে বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে আম্মার নিয়মিত চেকআপ এবং দেশে ফলোআপ করা হয়। একপর্যায়ে উনি একা একাই বিদেশে যাওয়া শুরু করলেন এবং কর্মচঞ্চল জীবন নিয়ে ভালোই ছিলেন। 

আমার বাবা সাদামাটা একটু ভিতু প্রকৃতির ছিলেন। একবার বাবা বলেছিলেন, ‘তোমার এত সাহস, মরণব্যাধি ক্যানসার নিয়ে এত সাবলীল জীবন কাটাচ্ছ।’ আম্মা বললেন, এখন মরণব্যাধি এইডস, ক্যানসার নয়। 

উনি নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। সব সময় ফিজিওথেরাপি নিয়েছেন নিজে নিজে। রেডিয়েশন দেওয়ার পর প্রথম দিকে শাড়ির আঁচলের নিচে হাতাকাটা ব্লাউজ পরতেন। একটি পাতলা হার্ট সেপ ছোট বালিশ বগলের নিচে রাখতেন। খাবারের ব্যাপারে সচেতন থাকতেন। 

 ২০০৩ সালে তিনি ঘাসফুলের প্রধান নির্বাহী পদ ছেড়ে দিয়ে চেয়ারম্যান হলেন এবং ২০১১ সালে শুধুই সাধারণ পর্ষদ সদস্য হলেন। মহীয়সী আমার মা দুঃখী মানুষদের দুঃখ ঘোচাতে নীলকণ্ঠী হয়েছেন। তিনি নিজেই ৭৫ বছর ধরে হেঁটে হেঁটে বর্ণাঢ্য এক ইতিহাসের পর্দা টেনে দিলেন ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। 

তাঁর মৃত্যুর পর মালেকা খান খালার কাছ থেকে জানতে পারলাম আম্মা এপিটাফ লিখে গেছেন। চিকিৎসার সময় যখন মন খারাপ থাকত, আম্মা তখন মাঝেমধ্যে তাঁর বাসায় যেতেন। একটা সোফায় শুয়ে শুয়ে গল্প করতেন। তখন উনি মাঝেমধ্যে বলতেন, অন্য কেউ লিখে রাখত। খালার মাধ্যমে আমি বাংলা ক্রাফটের কাজী শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁর কাছ থেকে পাই আম্মার চারটি এপিটাফ। সেখানে পড়ে দেখলাম, সব জায়গায় ওনার স্বজনদের পাশে ঘাসফুলের নাম রয়েছে। 

 কেমো দিয়ে এসেও আম্মাকে ঘাসফুলের ফাইল নিয়ে বসতে দেখতাম। কেমোর দুই দিন পর থেকে বেশি খারাপ হতো। মাঝেমধ্যে হতাশ হয়ে বলতেন, উনি নীড়হারা আশ্রয়হীন। ঘাসফুল তাঁর আরেকটি সন্তানের মতো ছিল বলেই উনি নিজেকে সামলে নিতেন। আমার মা আর ঘাসফুল একাকার ছিল, নিকটজনেরা এটা বুঝতে পারতেন। 

‘আমি ভালোবাসি তোমাদের 

পঞ্চরত্ন আর জেনেছি যাদের 

আমার নিঃশব্দ দোয়া আশীর্বাদ 

থাকবে সদা জানব সব সুবাদ 

সবুজ ঘাসের ঘাসফুল দুলিয়ে মাথা 

তোমাদের দেবে পরানের বারতা।’ 

আম্মার সৃষ্টি ঘাসফুল এখন এক পরিপক্ব মহিরুহ। তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন সব মানুষের মধ্যে। 

লেখক: সাবেক প্রেসিডন্ট, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)