হিরোশিমার হিবাকুশাদের কথা শুনুন

হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্কে হিরোশিমা দিবস-২০১৪ উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণ অনুষ্ঠানে জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ক্যারোলিন কেনেডিসহ (মাঝে) অন্য দেশের প্রতিনিধিরা। ছবি: এএফপি
হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্কে হিরোশিমা দিবস-২০১৪ উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণ অনুষ্ঠানে জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ক্যারোলিন কেনেডিসহ (মাঝে) অন্য দেশের প্রতিনিধিরা। ছবি: এএফপি

‘৬৯ বছর পরের এক বসন্ত। সূর্যের খর রোদ আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ‘‘ওই দিনে”। অগাস্ট ৬, ১৯৪৫। একটা পারমাণবিক বোমা হিরোশিমাকে পুড়িয়ে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল। শিশু থেকে বৃদ্ধ, হাজার হাজার নিরপরাধ বেসামরিক মানুষের প্রাণ গিয়েছিল এক দিনেই। বছর শেষে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ৪০ হাজারে। তাদের মনে রাখা আর ওই বিয়োগান্ত ঘটনাটির পুনরাবৃত্তিকে রুখে দাঁড়াতে হিবাকুশাদের কথা শুনুন।’ হিরোশিমার মেয়র কাজুমি মাতসুই এভাবে ‘হিবাকুশা’দের কথা শোনার আহ্বান জানিয়ে শুরু করেছেন ‘হিরোশিমা শান্তি ঘোষণা ২০১৪’।

জাপানিরা হিরোশিমা ও নাগাসাকি পারমাণবিক বোমা হামলার শিকার হয়ে প্রাণে বেঁচে থাকা মানুষদের বোঝাতে ‘হিবাকুশা’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। জাপান টাইমস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী জাপান এবং জাপানের বাইরে বসবাসকারী হিবাকুশাদের সংখ্যা চলতি বছরের মার্চ নাগাদ ১ লাখ ৯২ হাজার ৭১৯ জন। হিবাকুশাদের গড় বয়স প্রায় ৭৯ দশমিক ৪৪ বছর।

আজ হিরোশিমা দিবস উপলক্ষে হিরোশিমার মেয়র এক স্মরণানুষ্ঠানে হিরোশিমা শান্তি ঘোষণা পাঠ করেন। সকালে পিস মেমোরিয়াল পার্কে এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন পারমাণবিক বোমা হামলায় বেঁচে যাওয়া কয়েকজন মানুষসহ শত শত মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা হামলায় নিহত লোকজনের স্মরণে প্রতিবছর এই দিনে হিরোশিমা দিবস পালিত হয়।

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা নগরে যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমান এনোলা গে থেকে ‘লিটল বয়’ নামের পারমাণবিক বোমা ফেলার পর মুহূর্তের দৃশ্য। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা নগরে যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমান এনোলা গে থেকে ‘লিটল বয়’ নামের পারমাণবিক বোমা ফেলার পর মুহূর্তের দৃশ্য। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

এদিকে, আজকের অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে জাপানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ক্যারোলিন কেনেডিও উপস্থিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পরমাণু শক্তিধর অন্য দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার প্রতিনিধিসহ মোট ৬৭টি দেশের প্রতিনিধিরা এসে যোগ দিয়েছিলেন হিরোশিমা দিবসের এ স্মরণানুষ্ঠানে।
জাপানের হিরোশিমা নগরে ১৯৪৫ সালের ৬ অগাস্ট যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমান এনোলা গে থেকে ‘লিটল বয়’ নামের পারমাণবিক বোমাটি ফেলা হয়েছিল। স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে ৬০০ মিটার উচ্চতা থেকে বোমাটি ফেলে মার্কিন বৈমানিকরা। এতে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ নিহত হয়। আর আগস্টের ৯ তারিখে পাশের শহর নাগাসাকিতে ফেলা হয় ‘ফ্যাট ম্যান’ নামের আরেকটি পারমাণবিক বোমা। এর ছয়দিন পরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে আত্মসমর্পণ করে জাপানি বাহিনী।


বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ত্বরান্বিত করতে কাজ করে যেতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সরকারসহ সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান হিরোশিমার মেয়র। দুনিয়াজুড়ে জনগণের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অবিলম্বে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ আলোচনায় বসতে এবং ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে পারমাণবিক অস্ত্র পুরোপুরি বিলোপ করারও আহ্বান জানানো হয় মেয়র কাজুমি মাতসুইয়ের শান্তি ঘোষণায়।

হিরোশিমা শান্তি ঘোষণায় হিবাকুশাদের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়। এতে জানানো হয়েছে, বোমা হামলায় শহরের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোতে প্রায় ছয় হাজার বালক-বালিকা মারাত্মক আহত হয় এবং পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। আজও এদের অনেকেই সেদিনের মারাত্মক পিপাসায় ‘পানি পানি’ বলে চিত্কার করে ওঠা কিংবা ‘আগুন আগুন’ বলে আর্তচিত্কারে মাটিতে দোজখ নেমে আসার দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারেননি। হয়তো ভুলতে পারবেনও না যতদিন বেঁচে থাকবেন তাঁরা।

পারমাণবিক বোমায় হতাহতদের স্মরণে হিরোশিমা পিস ডোম-এর সামনে মোতায়াসু নদীতে আলোক-লণ্ঠন ভাসানো হচ্ছে। ফাইল ছবিটি ‘জাপান ফোকাস’ এর ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।
পারমাণবিক বোমায় হতাহতদের স্মরণে হিরোশিমা পিস ডোম-এর সামনে মোতায়াসু নদীতে আলোক-লণ্ঠন ভাসানো হচ্ছে। ফাইল ছবিটি ‘জাপান ফোকাস’ এর ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।

হিরোশিমার মেয়র দুনিয়া বাসীকে এই হিবাকুশাদের কথা শোনার আহ্বান জানিয়েছেন। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের শান্তিকামী মানুষ আজ হিরোশিমা দিবস পালন করে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের আহ্বান জানাবেন। কিন্তু এই পৃথিবী অচিরেই পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত হতে পারবে কি? বিখ্যাত মার্কিন তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার নোয়াম চমস্কিও হিরোশিমা দিবসকে ঘিরে লেখা এক নিবন্ধে এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। ‘মধ্যরাতের কত বাকি? হিরোশিমা দিবস ২০১৪’ শিরোনামে গতকাল প্রকাশিত দীর্ঘ ওই নিবন্ধের সূচনা অনুচ্ছেদটির ভাষান্তর এখানে তুলে ধরা হলো—

‘যদি ভিনগ্রহের কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষের ইতিহাস লিখতে বসত, তারা হয়তো এ জাতির কালকে দুই ভাগে ভাগ করে নিত—পারমাণবিক অস্ত্রের আগের সময় আর পারমাণবিক অস্ত্রের যুগ। দ্বিতীয় যুগের শুরু অবশ্যই ৬ আগস্ট, ১৯৪৫ সালে, মানব জাতির লজ্জাজনক অবসানের কাল গণনার প্রথম দিন সেটাই। যে জাতি নিজেদের ধ্বংসের কার্যকর উপায় আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে; কিন্তু তাদের কৃতকর্মের প্রমাণ বলছে— ভয়ংকরতম প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা তারা অর্জন করেনি।’