মাসকাট ম্যাসকট

খাঁজকাটা জাফরি দিয়ে জ্যামিতিক আলো পড়ছে পিচঢালা রাস্তায়। রাত নামলেই এই শহরের প্রতিটি সাদা গম্বুজ রঙিন আলোর প্রসাধনে সাজিয়ে ফেলে নিজেদের। তখন কে বলবে, রোদে রুক্ষ মরুবায়ুতে সারা সকাল জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়েছে ওরা।

শহরটায় কি একটাও রঙিন বাড়ি নেই? রং নেই মানুষের পোশাকেও! প্রথম যখন আরবের এই দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তীয় দেশ ওমানে পা রাখি, প্রশ্নগুলো তোলপাড় করত আমাকে। শেষে রঙের খোঁজ পেলাম নীল সাগরে, ধূসর-হলুদ মরুভূমিতে, আসমানি আকাশে আর টিয়ার ঝাঁকে। বড় রূপসী এই দেশ। তবে বাংলার মতো লাবণ্যময়ী নয়। রুক্ষ ও উগ্র। ওমানের আয়তন তিন লাখ নয় হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার। আয়তন বড় হলেও দেশটির জনসংখ্যা কম। আসলে জনবসতি হওয়ার মতো জায়গাই তো কম, মোট স্থলভাগের মাত্র ৩ শতাংশ।

বাকিটা জুড়ে রয়েছে পাথুরে উপত্যকা, তীক্ষ পাহাড়, বালিয়াড়ি। আরব সাগর ও গালফ অব ওমান দিয়ে ঘেরা দেশটির তিন দিক। সুপ্রাচীনকাল থেকেই সমুদ্রপথে বিভিন্ন জাতির আনাগোনা। মাটির তলার তামা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার বরাবরই আকৃষ্ট করেছিল বহির্বিশ্বকে। সুমেরীয় সভ্যতার প্রাচীন ফলকে ওমানের তামার খনির উল্লেখ আছে। আজও ওমান-গর্ভে অফুরান তেলভান্ডার। তাই শূন্য দশমিক ১১৪ ব্যয়সায় (বাংলাদেশি ২৫ টাকা) এক কাপ চা না মিললেও এক লিটার তেল মেলে।

শুধু আমাদের মতো তৃতীয় দুনিয়ার মানুষই নই, আর্থিক মন্দা টেনে এনেছে ইউরোপীয়দেরও। ওমানের রাজধানী মাসকাট স্থান দিয়েছে পৃথিবীর সব কোণের মানুষকেই। হাইপার মলে কাঁচকলার পাশে স্থান পেয়েছে ব্রাজিলিয়ান অ্যাভোকাডোও। চার মাসের মরা ইলিশের পাশে শুয়ে থাকে সদ্য মৃত হাঙর। এ যেন এক সুস্বাদু ককটেল, যা আস্বাদনে অরুচি নেই কারও। সবের থেকে সামান্য দূরত্ব বজায় রাখে স্থানীয় রমণীকুল। কালো ‘আবায়াব’ (বোরকা) ঢেকে দেয় এদের বাইরের অস্তিত্ব। কিন্তু এই আবরণী যেন কৌতূহলের আঁচ উসকে দেয়। আবরণ থেকে বেরিয়ে থাকা আঙুলের গাঢ় নেলপলিশ, কাজলে ভেজা দুচোখ যেন হাতছানি দেয় অদেখা মানুষটিকে। ওমানি পুরুষেরা আবার বেশ আপনভোলা। ছয়-আটটি বাচ্চা কোলে-পিঠে নিয়ে দিব্যি মৌজে থাকে। পরনের সাদা আলখাল্লা জানান দেয় তারা ‘স্বাধীন’।

মাসকাটে অনেক বাঙালি। সবার দেখা মেলে মাছের দোকানে। মাছ কেনার উৎসাহে এভাবেই আলাপ হলো পার্থদা-সুপর্ণা বউদির সঙ্গে। তাঁদের হাত ধরেই এখানকার বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের সুপ্রতিষ্ঠিত গম্ভীর ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে পরিচয়। বেশ হইহই করে দু-দুটো দুর্গাপূজা হয় এখানে। গান, বাজনা, জলসা, ভোজ তো রয়েছেই। যদিও প্রতিটি অনুষ্ঠানেই ঘোষণা হয় ইংরেজিতে। প্রাউড টু বি অ্যা বং...।

প্রতি শুক্রবার আমরা হাঁটতে যাই  সমুদ্রের ধারে। বেশ লাগে। সপ্তাহের ক্লান্তি শেষে সাগরের নোনা হাওয়া, এক কাপ কফি, আজানের মিষ্টি সুর। এমনি এক সন্ধ্যায় আরেকজন বাঙালির সঙ্গে আলাপ। তাঁর নাম আলী, বাড়ি চট্টগ্রামে। রাস্তার আলো বাঁচিয়ে, অন্ধকার বেয়ে বাদাম বিক্রি করেন। ফেরি করা এ দেশে নিষিদ্ধ, ধরা পড়লে নির্ঘাত জেল। কিন্তু উপায় নেই। বিদেশ দেখার বড় শখ ছিল। বাড়িতে জমি-জায়গা, স্ত্রী-সন্তান রেখে দুই পয়সা বেশি রোজগারের আশায় এসেছিলেন এ দেশে। যে দোকানে কাজ করতেন, তা উঠে গেছে। ভিসা শেষ হয়ে গেছে পাঁচ বছর। বিমানভাড়া দিয়ে নতুন ভিসা করে দেশে ফিরতে গেলে হয়তো বাড়ি, জমিজমা সব বেচতে হবে। তার চেয়ে এভাবেই কাটুক...

ওমান স্বপ্নের দেশ, না স্বপ্নভঙ্গের?