নির্জন নোবিপ্রবিতে ডানা মেলেছে প্রকৃতি

করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ যখন ঘরবন্দী, প্রকৃতি তখন উন্মুক্ত। এ সুযোগে কমেছে দূষণের মাত্রা। নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পেয়েছে প্রকৃতি। এই তো কিছুদিন আগেও ক্যাম্পাস পদভারে ক্লান্ত ছিল। বাংলাদেশে অন্যতম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি)। সেখানে এখন বাসা বেঁধেছে পাখিরা, ঘাস-লতা-পাতা। রাজত্ব করছে প্রকৃতি নিজেই। ক্যাম্পাসের এমন দৃশ্য একেবারেই বিরল।
এক মাস আগেও বিশ্ববিদ্যালয় হাজারো শিক্ষার্থীর সমাগমে ক্লান্ত ছিল। কিন্তু ক্লান্ত ক্যাম্পাস এখন একেবারেই অচেনা, প্রকৃতির ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে চিরচেনা দৃশ্য। ১০১ একর ক্যাম্পাসজুড়ে এখন কেবলই নির্জনতা। সেখানে আজ পাখির কলকাকলি ছাড়া আর কোনো কোলাহল নেই। করোনাভাইরাসের কারণে প্রশাসনের কঠোর নিষেধাজ্ঞায় মানুষ যখন ঘরে ঘরে বন্দী, প্রকৃতি তখন মুক্ত।
সরেজমিন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুরে দেখা যায়, ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই ডান পাশে প্রশান্তি পার্ক। পার্কের যে মাটিগুলো মানুষের পদচারণে মুখরিত থাকত সেই পার্কে আজ ঝরা পাতাগুলো বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। নেই কোনো কোলাহল, নেই কোনো ভিড়। শুধু বৃক্ষগুলো নীরবে স্ব বুলিতে কিছু বলে বেড়াচ্ছে।

মূল গেট থেকে সোজা রয়েছে ক্যাম্পাসের গোল চত্বর। যেখানে প্রতিনিয়ত বন্ধুদের সঙ্গে জমে উঠত বেশ আড্ডা। কখনো ক্লাস শেষে আবার কখনো ক্লাসের ফাঁকে। সেই গোল চত্বর আজ জনমানবশূন্য হয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর পা স্পর্শ করেছে প্রশাসনিক ভবন থেকে সালাম হলের রোডটি। নির্জনতায় পড়ে আছে এই রোড, নেই কোনো চলাচল। রাস্তার দুধারে ঘাসগুলো বাধাহীনভাবে বাড়ছে, রাজত্ব করছে রাস্তাটিকে। স্বাধীনভাবে লতাপাতা বেয়ে যাচ্ছে রাস্তার ওপাশে।
প্রতিবছরের মতো নির্জন ক্যাম্পাসে ডানা মেলেছে সূর্যমুখীরা। চারদিকে হলুদ ফুল আর সবুজ গাছ সে এক অপরূপ দৃশ্য। যত দূর চোখ যায় দেখে মনে হয় বিশাল আয়তনের হলুদ এক গালিচা। চোখে পড়ে শুধু সূর্যমুখী ফুল। আর এই ফুলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মনোরম দৃশ্য স্মৃতির পাতায় বন্দী করছেন অনেকেই। কেউ ফুলের সঙ্গে ছবি তুলে স্মৃতির পাতায় জমিয়েছে। কিন্তু এবারের দৃশ্যটি ভিন্ন রকম নেই কোন হাসির ঝলক। নেই কোনো ছবি তোলার ভিড়। নীরবে দাঁড়িয়ে আছে হলুদ ফুল ওয়ালা সবুজ গাছ। করোনা প্রভাবের ছাপরেখা শুধু ব্যক্তিমনেই না প্রকৃতির সৌন্দর্যকেও ছেয়ে গেছে।

আবদুস সালাম হল রোড ও লাইব্রেরি ভবন রোডের মিলনস্থলে অবস্থিত হতাশার মোড়। আজ থেকে ১২ বছর আগে যেখানে এসে থেমে যেতে ক্যাম্পাসের ছেলেদের পায়ের কদম কখনো এটি হয়ে যেত প্রেমিক-প্রেমিকাদের দিনের শেষ সাক্ষাৎ এর একটি পরিচিত স্থান। সেই মোড়টিও আজ জনমানবশূন্য। চারপাশের গাছপালা আর লতাপাতা ছাড়া কিছুই নেই।
নোবিপ্রবির ১০১ একরে লাইব্রেরি রোডের পাশেই টংগুলো অবস্থিত। টং থেকে সামান্য দক্ষিণে গেলেই লাইব্রেরি ভবন, যেখানে পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকে অনেক শিক্ষার্থী। ক্লাস টেস্টের পড়া, অ্যাসাইনমেন্ট, ল্যাব রিপোর্টের ক্লান্তি শেষে একটু আড্ডা দিতে যায় টংয়ের দোকানগুলোতে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা গল্পে দূর হয়ে যায় সব ক্লান্তি। যেখানে খালি গলায় কিংবা গিটারে সুরে গাওয়া হতো দু–চার লাইন, বন্ধুরা মিলে লেখা হতো নতুন কোনো ছন্দ, কেউবা বাঁধত নতুন কোনো গান, সেখানে আজ নেই কোনো সুরের ঐকতান। সেই টংগুলো আজ পড়ে আছে, নেই কোনো আড্ডা।

ক্যাম্পাসের গাছগুলোতে বাসা বাঁধছে পাখির দল। ফাঁকা ক্যাম্পাসজুড়ে এদিক–ওদিক ছোটাছুটি করছে অতিথি পাখিরা। ময়নাদ্বীপে খেলা করছে অতিথি পাখির দল। চারপাশের লতাপাতা এখন বিনা বাধায় ডালপালা মেলছে।
নিস্তব্ধ হয়ে আছে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অজস্র প্রেমের সাক্ষী হয়ে থাকা নীলদিঘি। যেই দিঘির পাড়ে কেউ লুডু খেলায়, কেউবা ঘুঁটি খেলায় একদল আবার কার্ড খেলায় কখনো দাবার বোর্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকত। সেই দিঘির পাড়ে আজ ঘাস লতাপাতার রাজত্ব, নেই কোনো চলাচল। পাড়ের দুধারের ঘাসগুলো বেড়ে উঠেছে রাস্তার দিকে।

নীরবে দাঁড়িয়ে আছে ভালো লাগার এই লালবাস-সাদাবাস। এই বাস ঘিরেই নোবিপ্রবিয়ানদের হাজারো স্মৃতি, হাজারো গল্প। স্বপ্নবাজ তরুণদের নিয়ে প্রাণ ফিরে পায় এই যানবাহনগুলো। করোনার ছুটিতে বাসগুলো তার প্রিয়মুখগুলোর ফিরে আসার অপেক্ষার প্রহর গুনছে। অপেক্ষার প্রহরের অবসান ঘটিয়ে বাসের সব যাত্রী তার স্বপ্নভূমিতে ফিরবে। সাদা, লাল বাস আবার তার আপন গতি ও প্রাণ ফিরে পাবে। তৈরি হবে নতুন গল্প, এমনটাই প্রত্যাশা শিক্ষার্থীদের।