অসমতার কারণ ও পিকেটির পরামর্শ

টমাস পিকেটি একজন ফরাসি অর্থনীতিবিদ। তাঁর গবেষণার মূল বিষয় আয় ও সম্পদের বৈষম্য এবং সামাজিক অসমতা। ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ তাঁর একটি বিখ্যাত বই। ২০১৩ সালে প্রকাশিত বইতে তিনি বলেছেন, পৃথিবীতে বর্তমানে আয়বৈষম্য এবং অসমতার মাত্রা খুব বেশি। শত বছরের ইতিহাসের আলোকে বিশ্লেষণ করে তিনি বলেছেন, প্রায় অর্ধশতক ধরে তা কেবল বাড়ছেই। তাঁর মতে, এর আগে গ্রেট ডিপ্রেশন কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং সরকারি কিছু জনকল্যাণমুখী নীতির কারণে (যেমন আয়কর ব্যবস্থা) ৩০ দশকের প্রথম দিক থেকে শুরু করে ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত সময়কালে ইউরোপ ও আমেরিকায় অসমতা অনেকটা কমেছিল।

নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পুঁজিবাদকে একমাত্র একক, শক্তিশালী এবং সর্বজনীন মতাদর্শ হিসেবে ভাবতে শুরু করে বেশির ভাগ দেশ। আমেরিকান রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা ‘এন্ড অব হিস্ট্রি এন্ড দ্য লাস্ট ম্যান (১৯৯২)’ নামে একটি বই লিখেছেন। বইয়ে তিনি যুক্তি দেখান, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের ফলে দুই মেরুকেন্দ্রিক বৈশ্বিক দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটেছে। ফলে পুঁজিবাদ বিশ্বজয়ী মতাদর্শে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর সব রাষ্ট্র এখন থেকে পুঁজিবাদকেই তাদের আর্থসামাজিক মতাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে। ফুকুইয়ামার এ ধারণা মোটেই অমূলক ছিল না। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ বয়ে চলছে। এর অনেক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন এসেছে। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অর্জন করেছে। হয়েছে ক্রমশ শক্তিশালী। পৃথিবীজুড়ে চলছে পুঁজিবাদের জয়জয়কার। আর ক্রমবর্ধমান অসমতা আর আয়বৈষম্য তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছেই কেবল অবিরাম।

পুঁজিবাদের এই বদনাম অবশ্য বেশ পুরোনো। কার্ল মার্ক্সের ‘দাস ক্যাপিটাল’ বিখ্যাত বই। প্রায় দেড় শ বছর আগে লেখা বইটিতে তিনি অর্থনৈতিক অসম বণ্টনের মাধ্যমে কীভাবে শোষক এবং শোষিত শ্রেণি সৃষ্টি হয়, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি পুঁজিবাদী সমাজের উৎপাদনব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটি তুলে ধরেন। তাঁর মতে, মানুষের শ্রমশক্তি একটি পণ্য এবং এই পণ্যের বিনিময় মূল্য এবং ব্যবহারিক মূল্য আছে। শ্রমের জন্য শ্রমিককে যে মূল্য দেওয়া হয়, তা হচ্ছে বিনিময় মূল্য আর শ্রম দ্বারা সৃষ্ট দ্রব্যাদি বাজারজাত করে যে মূল্য শিল্পপতিরা অর্জন করেন, তা হচ্ছে ব্যবহারিক মূল্য।

মার্ক্স এই ধারণা দেন, শ্রমিককে প্রদত্ত পারিশ্রমিকের চেয়ে এর ব্যবহারিক মূল্য সব সময় বেশি থাকে। ব্যবহারিক মূল্যের এ বাড়তি অংশকে তিনি ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর তত্ত্বটি ‘উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব’ নামে পরিচিত। তিনি মনে করেন, উৎপাদনের মাধ্যমগুলো যখন যে শ্রেণির হাতে থাকে, সেই শ্রেণিই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রাধান্য লাভ করে। আর এই উৎপাদনব্যবস্থায় সমাজ পুঁজিপতি ও সর্বহারা—এ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত হয়। মার্ক্স আক্রমণ করেছিলেন পুঁজিবাদকে। তিনি পুঁজিবাদকেই মূলত দায়ী করেছেন অসমতার কারণ হিসেবে।

যাহোক, আবার পিকেটির কথায় ফিরে আসি। তিনি আয়বৈষম্য আর অসমতার একটা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনিও মনে করেন, অসমতার এই গন্ডগোলের অন্যতম কারণ পুঁজিবাদ। তিনি বলেছেন, আয়ের দিক থেকে একজন গড় নাগরিকের আয় বৃদ্ধির হার এবং গড়পড়তা জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার কাছাকাছি হওয়া উচিত। আবার যাঁদের আয়ের প্রায় সবটাই পুঁজি থেকে অর্জিত সুদ, তাঁদের আয় বৃদ্ধির হার হবে সুদের হারের কাছাকাছি। কিন্তু পিকেটির গবেষণা বলছে, আয় বৃদ্ধির হার সব সময়ই সুদের হার থেকে কম থাকছে। এই সুদ থেকে অর্জিত আয়ের সিংহভাগ যদি আবার সঞ্চিত হতে থাকে, তবে স্বাভাবিকভাবেই এই আয়ের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। আসলে ঘটছেও তা–ই। তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় আয়ে পুঁজি থেকে অর্জিত আয়ের ভাগ ক্রমে বেড়েছে।

পিকেটি উত্তরাধিকারভিত্তিক ধনতন্ত্রের সমালোচনা করেছেন। অনেকের মনে হতে পারে, উত্তরাধিকারভিত্তিক ধনতন্ত্রের মধ্যে সমস্যা কী? কেউ যদি তাঁর সঞ্চিত ধন সন্তান-সন্ততিকে উত্তরাধিকারী হিসেবে দেন, তাতে দোষের কী? এখানে সমস্যাটি হলো, এতে সৃষ্ট আর্থিক অসমতা থেকে তৈরি হয় ক্ষমতা বা প্রভাবের অসমতা। আর ক্ষমতার অসমতা যত বাড়বে, ধনীদের রাজনৈতিক প্রভাব মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণির মানুষের তুলনায় তত বেশি বাড়বে। ফলে দেখা যাবে, গণতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষের একটি করে ভোট দেওয়ার সুযোগ হয়তো থাকবে, কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখা যাবে, সব মানুষ সমান নয়। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা কিন্তু সে কথাই বলে।

আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১১ সালের ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’ আন্দোলনের কথা। পুঁজিপতিদের অর্থ লোভ, সীমাহীন দুর্নীতি, সরকারি নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোতে ধনী পরিবার ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যায় প্রভাবের কারণেই সৃষ্ট অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ ছিল এই আন্দোলন।

টমাস পিকেটি তাঁর গবেষণায় মূলত আয়করবিষয়ক তথ্য-উপাত্ত নিয়েই কাজ করেছেন। কয়েকটি ধনী দেশের এক শ বছরের বেশি সময়ের করসংক্রান্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে পিকেটি দেখিয়েছেন কীভাবে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন এবং দুনিয়াজুড়ে আয়বৈষম্য বাড়ছে। আর তাই তিনি এই অসমতা কমানো বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য করকে একটি উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ১৯৯২ সালে আমেরিকায় সর্বোচ্চ উপার্জনকারী চার শ করদাতাকে গড়ে আয়ের ২৬% কর দিতে হতো। ২০০৯ সালে এই হার কমে দাঁড়ায় ২০%। তিনি মনে করেন, ইউরোপের অসমতার মাত্রা আমেরিকার তুলনায় কম হওয়ার একটি কারণ হলো কর হারের ফারাক। তাই তাঁর প্রস্তাব হচ্ছে, পুঁজি থেকে অর্জিত আয়ের ওপর কর আদায় করা হোক এবং সব দেশেই সেটা এক হারে করা হোক।

টমাস পিকেটি ধনীদের কাছ থেকে অধিক হারে কর আদায় করে তা গরিব ও সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয় করার পক্ষপাতী। তিনি এটিও মনে করেন, সমাজের সম্পদশালীরা সরকারের সিদ্ধান্তগুলোকে নানাভাবে প্রভাবিত করে থাকে। ফলে একদম কঠিন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সরকারের পক্ষে তাদের কাছ থেকে সঠিক কর আদায় করা কঠিন। আর এ জন্য দরকার বিত্তশালীদের ওপর সামাজিক চাপ সৃষ্টি করা। আর এই চাপ সৃষ্টির উপায় হিসেবে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন আদায় করা করের তথ্য যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত ও নিয়মিত জনগণের কাছে প্রকাশ করা। তাঁর মতে, এর ফলে একদিকে সরকারের কাজের স্বচ্ছতা যেমনি বাড়বে, অন্যদিকে বিত্তশালীদের ওপর একধরনের সামাজিক চাপও তৈরি হবে।

পিকেটি আয়বৈষম্য আর অসমতা নিয়ে আরেকটি বই লিখেছেন ২০১৯ সালে। তাঁর নতুন বইটির নাম ‘ক্যাপিটাল অ্যান্ড আইডোলজি’। আগের বইটিতে তিনি মূলত শত বছরের তথ্য–উপাত্তের আলোকে বিশ্লেষণ করে অসমতা বৃদ্বির দালিলিক প্রমাণ দিয়েছেন। আর এই নতুন বইতে তিনি আলোচনা করেছেন অসমতা আর আয়বৈষম্যের ইতিহাস নিয়ে। বলেছেন কীভাবে বিভিন্ন মতাদর্শ হাজার বছরের চেয়ে বেশিকাল সময় ধরে অসমতা এবং আয়বৈষম্য জিইয়ে রেখেছে। তিনি সামন্তবাদী যুগ থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত সমাজকে তিনটি নবযুগে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো রেন্টিয়ার সোসাইটি, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক সোসাইটি এবং নিও-রেন্টিয়ার সোসাইটি।

রেন্টিয়ার সোসাইটি বলতে পিকেটি ফরাসি বিপ্লব থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত বুঝিয়েছেন। আর সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক সোসাইটির সময়কাল বলছেন ১৯৪৫ সাল থেকে আশির দশক পর্যন্ত। এরপর থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত সময়কে বলছেন নিও-রেন্টিয়ার সোসাইটি। তাঁর মতে, এই তিন যুগের মধ্যে একমাত্র সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক সোসাইটি ছাড়া বাকিগুলোতে চরম সামাজিক অসমতা ছিল। সব কটিতেই ধনীরা কেবলই ধনী হচ্ছিল আর গরিবেরা গরিব।

বইটিতে পিকেটি সেই করের কথাই বলেছেন। ধনীরা সব অসম যুগে খুব কমই কর প্রদান করতেন। শ্রমজীবী লোকেরাই মূলত প্রায় পুরো করের বোঝা বহন করতেন। মধ্যযুগেও অভিজাতেরা করমুক্ত ছিল। পিকেটির মতে, কেবল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিকদের সময় অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকে আয় এবং সম্পদের বণ্টন কিছুটা সুষম ছিল। পরবর্তী ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এটি স্থিতিশীল ছিল। আর তা সম্ভব হয়েছিল প্রগতিশীল কর এবং উত্তরাধিকার করের কারণে। এর ফলে সম্পদ অতীতের মতো ততটা তাদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়নি। ১৯৮০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ আয়কর হার ছিল ৮১ শতাংশ আর যুক্তরাজ্যে এটি ছিল ৮৯ শতাংশের বেশি। এই সময় রাজনীতিবিদেরা কর থেকে প্রাপ্ত অর্থ শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করেছিলেন। মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর জন্য এটি বিশেষ উপকারী ছিল এবং পাশাপাশি সামাজিক সাম্যতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

আশির দশক থেকেই আবার হঠাৎ করে শীর্ষ আয়কর হার ক্রমাগত কমতে থাকে। ধনী ও করপোরেশনগুলোর জন্য কর কমিয়ে দেওয়া হলো। শ্রমজীবী জনগণ আবারও বেশির ভাগ করের বোঝা বহন করতে শুরু করল। নব্য উদারপন্থীরা এবং রক্ষণশীলেরা উত্তরাধিকার কর বিলুপ্ত করে দিল। তার সঙ্গে ছিল বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার আর লেনদেনের উদারীকরণ। ফলে সম্পদ আরও কেন্দ্রীভূত হওয়ার সুযোগ পেল। ফলস্বরূপ আমরা পেলাম আয়বৈষম্য আর অসমতার বর্তমান এই রূপ।

তাই আয়বৈষম্যে আর অসমতা কমাতে পিকেটি আবার সেই কর আদায়ের কথাই বলছেন। সেই সঙ্গে একটি পার্টিসিপেটরি সোশ্যালিজম বা অংশগ্রহণমূলক সমাজতন্ত্রের ধারণা দিয়েছেন। তাঁর অংশগ্রহণমূলক সমাজতন্ত্র কেন্দ্রীয় এবং উত্তর ইউরোপের সামাজিক অংশীদারিত্ব মডেলের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া। তিনি কোম্পানির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ অর্থাৎ কো–ডিটারমিনেশনের বা সংহতিকরণের কথা বলছেন। তাঁর মতে, কোম্পানিতে তাঁদের মতামতেরও গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারি খাতের সঙ্গে সঙ্গে একটি শক্তিশালী বেসরকারি খাত থাকতে হবে। আর রাষ্ট্রের কাজ হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত বিষয়গুলোকে সংঘটিত করা। বাজারকে নয়।

* লেখক: বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা। [email protected]