মেঘনায় হারিয়ে যাচ্ছে সব, নেই আস্ত বাজার

নদীতীরের কোনো এক এলাকায় গড়ে উঠেছে একটি শিক্ষিত কমিউনিটি। যেখানের ছেলেমেয়েরা দেশের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। এক থেকে অন্যের মধ্যে একটা ভিত গড়ে উঠেছে। সেখানের ছেলেদের দেখেছি, ক্রিকেট উন্মাদনায় মেতে উঠতে। বিপিএল, আইপিএলের আদলে তাঁরা টুর্নামেন্টের আয়োজন করতেন এইচপিএল।
একটা এলাকার বিরাট অংশজুড়ে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে এতটাই বন্ধন ছিল যে এইচপিএল নামের টুর্নামেন্টটি বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে আয়োজিত হতো। খেলাটি দেখার জন্য আমি ৭-৮ কিলোমিটার মেঠো পথ ছুঁয়ে যেতাম। আমার স্মৃতিতে এখনো জমা টুর্নামেন্টটির চার-ছক্কার মার কিংবা উইকেট শিকার, যত আক্রমণাত্মক দৃশ্য। একটা সময় এসে ওখানের মাঠে বল গড়ায় না! কারণ কী? দেখতে পেলাম, এলাকার তরুণেরা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। একেকজন একেক এলাকার বাসিন্দা। এখন আর একসঙ্গে কারও আড্ডা হয় না। বল-ব্যাটে কারও এখন আর একসঙ্গে ক্রিকেট খেলা হয় না।
এ এইচপিএল হচ্ছে হাজিগঞ্জ প্রিমিয়ার লিগ। কমলনগর উপজেলার পশ্চিম চর লরেন্সে বাজারটির অবস্থান। কিন্তু নদীগর্ভে বিলীন বাজারটি এখন আর নেই। তিন-চার বছর আগেই মেঘনার পেটে হারিয়ে যায় হাজিগঞ্জ বাজার, বাজার এলাকার জনপদ।
বলে রাখা ভালো, ওখানে আমার নানার বাড়ি। ছোটবেলার অনেক স্মৃতিবিজড়িত একটি স্থান আমার। ছোটবেলায় কত যে দুরন্ত স্বভাবের ছিলাম, নলকূপের পানিতে কপাল ফেটে কপালে দাগ রয়ে যাওয়ার চিহ্নটি এখনো আমাকে ওই অঞ্চলের কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়। হাজিগঞ্জ এলাকার কয়েক একর জমি ছিল নানাদের। ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া আমাদের সাড়ে ৫ গণ্ডা জমিও নদীতে ভেঙে গিয়েছিল।

বলতে চেয়েছিলাম, একটি সভ্যতার অপমৃত্যু ঘটেছে। এমন উদাহরণ হয়তো একটি জায়গার। কিন্তু লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলায় এমন আরও গল্প পাওয়া যাবে। ৫–৬ বছর ধরে লেখালেখি করি। লেখালেখির শুরু থেকেই কমলনগরের নদীভাঙন নিয়ে লেখালেখি করে আসছি। একটা পর্যায়ে এসে এখন আর নদীভাঙন নিয়ে লিখতে গিয়ে শব্দ–সংকটে পড়ে যাই। লেখার ভাষা খুঁজে পাই না, মানুষের কষ্ট আর কীভাবে তুলে ধরি। তারপরেও চেষ্টা করি৷ কমলনগরে নদী কেন ভাঙে? কারণ খোঁজার সৃষ্টি করি। এখন উপলব্ধি হলো, তিনটি কারণে কমলনগরের নদী ভাঙছে, প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ। দেখার কেউ নেই।
এক. মজবুত বেড়িবাঁধ। নদীভাঙন প্রতিরোধে বেড়িবাঁধ নির্মাণকে আমি অবশ্যই প্রধান উপায় হিসেবেই স্থান দেব। বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে, নদী এসে থমকে গেছে রামগতির চর আলেকজান্ডারে। সেনাবাহিনীর দ্বারা নির্মিত এ বেড়িবাঁধ মজবুত বলে সবখানেই প্রশংসা কুড়াচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি বড় উদাহরণ হতে পারে। যার কারণে সেখানে নদীভাঙন নেই। ওই এলাকা একটি পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে কমলনগরের মাতাব্বরহাট নদীর তীর রক্ষা বাঁধে যে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, তার অনিয়ম, দুর্নীতির কথা সবারই জানা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে এ বেড়িবাঁধ ১০ বার ধসে পড়েছে। যার কারণে নদীভাঙন রোধে মজবুত বেড়িবাঁধ অন্যতম একটি বড় উপায়।

দুই. নাব্যতা–সংকটের কারণে মেঘনা নদীর চ্যানেল জোয়ারের স্রোত চলাচলে বাধাগ্রস্ত হয়। নদীশাসন না করার কারণে নাব্যতা–সংকট নদীভাঙনের অন্যতম একটি কারণ হয়ে উঠেছে। নদী বাঁধের সঙ্গে ড্রেজিং করার কথা থাকলে নদীতে ড্রেজিং হয়নি। যার কারণে নদীর পানি চলাচলে বাধা পেয়ে তীরের দিকে ধেয়ে আসে এবং তীরে এসে প্রবল বেগে ধাক্কা দেয়। জোয়ারের পানিতে এ ভাঙন তীব্র হয়ে ওঠে।
তিন. নৌপথে জাহাজের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল। ঢাকা-চট্টগ্রাম নৌরুটে যে জাহাজগুলো চলছে, সে জাহাজগুলো একদম নদীর কিনার দিয়ে যায়। এ কারণে নদীর পানির স্রোতও অস্বাভাবিকভাবে তীরে আঘাত করে এবং নদী ভাঙে জোরেশোরে। সরকার এ জাহাজগুলো থেকে দৈনিক কোটি কোটি টাকা আয় করে। কিন্তু কমলনগর এ জাহাজগুলো দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।