বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ও আমাদের উচ্চশিক্ষা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতায় খারাপ খবরই চোখে বেশি পড়ে। তারপরও দু–একটি সুখবরের প্রত্যাশায় প্রতিদিন সংবাদপত্রে চোখ বুলিয়ে যাই। ভাবি, অন্তত একটি সংবাদ হলেও দৃষ্টিগোচর হবে, যা মনের খোরাক জোগাবে, আমাদের আনন্দ দান করবে। নিজ দেশের ইতিবাচক খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হলে স্বাভাবিকভাবেই মন উৎফুল্ল থাকে। নেতিবাচক খবর মনকে আরও খারাপ করে রাখে। যদি নেতিবাচক খবর উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে মন আরও বিষণ্নতায় নিমজ্জিত থাকে।

কিছুদিন আগে পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি, যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাঙ্কিং নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান কিউএস বিশ্বের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে একটি র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করে। কিউএস যুক্তরাজ্যের এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা সারা বিশ্বের এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করে থাকে। র‍্যাঙ্কিং বিবেচনায় আমাদের দেশের মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। একটি হলো বুয়েট, অন্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তা–ও বিশ্ববিদ্যালয় দুটি শেষের দিকে স্থান করে নিয়েছে। দেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই!


যুক্তরাজ্যের সিআইবি নেতা রিচার্ড ল্যাম্বার্ড ‘The Lambert Review of Business University Collaboration’- এর এক প্রতিবেদনে ২০০৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিংবিষয়ক ধারণাটি প্রথমে সামনে নিয়ে আসেন। এরপর থেকেই কয়েকটি সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং বিষয় নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাজ্যের টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) ও কিউএস এবং চীন থেকে প্রকাশিত একাডেমিক র‍্যাঙ্কিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ।


তবে সেই প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ কতগুলো উপাত্তের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন সূচকের মাধ্যমে র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করে থাকে। প্রথম দিকে অর্থাৎ ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত Times Higher Education (THE) এবং QS (Quacquarelli Symonds) একত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করে। কিন্তু ২০১০ সাল থেকে কিউএস এবং টাইমস হায়ার এডুকেশন আলাদাভাবে র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করা শুরু করে।


তবে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত QS (Quacquarelli Symonds) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাঙ্কিং নির্ণয়ে প্রথম থেকেই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে আসছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং নির্ণয়ে কিউএসের গ্রহণযোগ্যতা তুলনামূলকভাবে বেশি। কিউএস বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং নির্ণয়ে মোট ছয়টি সূচকের মাধ্যমে সামগ্রিক মান নিরূপণ করে থাকে।
সূচক ছয়টি হলো:
একাডেমিক খ্যাতি
চাকরির বাজারে সুনাম
শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত
শিক্ষকপ্রতি গবেষণা উদ্ধৃতি
আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত এবং
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাত।

একাডেমিক খ্যাতি বা রেপুটেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং তৈরিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এই পদ্ধতিতে র‍্যাঙ্কিং নির্ণয়ের জন্য ৪০ মার্কস বরাদ্দ রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে অতি নামী-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম র‍্যাঙ্কিংয়ের সামনে চলে আসাই স্বাভাবিক। একাডেমিক খ্যাতি বা রেপুটেশন সূচক নির্ধারণের জন্য সারা বিশ্ব থেকে উচ্চশিক্ষায় সম্পৃক্ত গবেষকদের মতামত চাওয়া হয়। তাঁরা নিজ প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্য ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে ভোট প্রদান করতে পারেন। যাঁদের মতামতের ভিত্তিতে নেওয়া হয় তাঁদের অবশ্যই কমপক্ষে ১০ বছরের ওপরে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। ২০১৭-১৮ সালে ৭৫ হাজার ১৫ জন গবেষকের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে সূচক নির্ণয় করা হয়। তবে আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গবেষণা কম হয়। শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ রাখা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন ও পরিচালনার ব্যয় নির্বাহ করতেই তা চলে যায়। গবেষণা খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ২.৩ শতাংশ, যা গবেষণা খাতের জন্য খুবই কম বলা চলে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

আরেকটি সূচক হলো চাকরির বাজারে সুনাম। সময়ের আবর্তনে এই সূচক যেকোনো সময় পরিবর্তিত হতে পারে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এই সূচক অক্ষুণ্ন রাখা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে চাকরি বাজার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চাকরির বাজারে সুনামখ্যাত সব প্রতিষ্ঠানের কাছে জানতে চাওয়া হয় কোন বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট কেমন তৈরি করছে। তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে সূচক নির্ধারণ করা হয়। এই সূচকে ১০ মার্কস ইন্ডিকেটর রূপে কাজ করে। তাই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভালো অবস্থান দখল করে আছে, তাদের পক্ষে মতামত প্রাধান্য পায় বলে র‍্যাঙ্কিং নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সঠিক প্রতিফলন নির্দেশ করতে সহায়তা করে। অন্যান্য উন্নত দেশের গ্র্যাজুয়েটদের তুলনায় আমাদের দেশের অতি কমসংখ্যক গ্র্যাজুয়েটই বিশ্বের সুনামখ্যাত প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত রয়েছেন। তাই সূচক নির্ণয়ে আমরা স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে যাই।


পরের সূচকটি হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত। কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের ওপর ভিত্তি করে এটি নির্ণয় করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতিক হার যত কম হবে, ততই গুণাগুণসম্পন্ন হবে—এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে সূচক নির্ণীত হয়ে থাকে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা ধরে রাখতে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। র‍্যাঙ্কিং নির্ণয়ে এখানে ২০ মার্কস বরাদ্দ রাখা হয়।


শিক্ষকপ্রতি গবেষণা উদ্ধৃতি র‍্যাঙ্কিং নির্ণয়ে আরেকটি ইন্ডিকেটর। এটি আসলে প্রথম সূচকটির সঙ্গে সম্পৃক্ততার নামান্তর মাত্র। কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কয়টি গবেষণা বের হলো, তার সূচক নির্দেশ করে। তবে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বেশি গবেষণা প্রকাশিত হলেই যে বেশি মান নিরূপিত হবে, তেমনটি কিন্তু নয়। কারণ, প্রতিটি গবেষণার বিপরীতে মোট শিক্ষকের সংখ্যা নিরূপিত হয়ে থাকে। সূচকটিতে র‍্যাঙ্কিং নির্ণয়ের জন্য ২০ মার্কস বরাদ্দ রাখা হয়। তাই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি শিক্ষক বা কম শিক্ষক সেখানে কোনো প্রভাব ফেলবে না। কয়টি গবেষণার উদ্ধৃতি বের হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করবে। একাডেমিক খ্যাতি এবং শিক্ষকপ্রতি গবেষণা উদ্ধৃতি সূচক দুটি বলতে গেলে পরিপূরকই বটে। অর্থাৎ যে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার স্থান যত বেশি পাবে, র‍্যাঙ্কিংয়ে ওপরের দিকে আসা সহজতর হবে। দুটি সূচকে মোট ৬০ মার্কস গবেষণা তথ্যের ওপরই নির্ভর করে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সূতিকাগার রূপে গবেষণাগার অত্যাবশ্যক, যা আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবেই কম।


অন্য একটি সূচক হলো আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত। এই সূচকে ৫ মার্কস বরাদ্দ থাকে। একটি দেশে আন্তর্জাতিক শিক্ষক নিয়োগের ওপর নির্ভর করে সূচকটি নির্ধারিত হয়। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক শিক্ষক নেই বললেই চলে। তাই উক্ত সূচকটিও আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র‍্যাঙ্কিং নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে।

পরের সূচকটি হলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাত। একটি দেশের মাঝে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে জরিপ করা হয়। অন্যান্য দেশ থেকে আগত আমাদের দেশে শিক্ষার্থী অনুপাত তুলনামূলকভাবে খুবই কম থাকে। সে জন্য সূচকটি আমাদের জন্য নেতিবাচকই বটে।

সব সূচক বিবেচনায় এগিয়ে থেকে পার্শ্ববর্তী দুটি দেশ ভারতের ২১টি এবং পাকিস্তানের ৭টি বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাঙ্কিংয়ে স্থান পায়। অথচ আমাদেরও গর্বের বিষয় হতে পারত একসময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
স্বপ্নের স্তরে ওঠার পরিস্ফুটনে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ আমাদের কাছে অতি মূল্যবান। তবে আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করলেও ধাবমান হওয়া কঠিন বাস্তবতায় ঠেকে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগমুহূর্তে কল্পিত মনে যে আশাটুকু নিয়ে কোনো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তাতেও ছেদ পড়ে! যেটা আমিও অনুভব করেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর। ক্লাস শুরুর পর্যায়েই প্রায় দেড় বছর জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল। তখনো বুঝতে পারিনি শিক্ষাক্ষেত্রে সেশনজটের কালো থাবা জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে! সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো অভিভাবক শিক্ষাক্ষেত্রে খুঁজে পাইনি। সেমিস্টারের এক ক্রেডিটের কোর্স সপ্তাহে এক ঘণ্টা হওয়ার কথা থাকলেও চার ক্রেডিটের কোর্স সর্বমোট চারটি ক্লাসের (চার ঘণ্টা) মাধ্যমেই পরিসমাপ্তি ঘটতেও দেখেছি! ম্যাড়ম্যাড়ে অবস্থানে থেকে কোনোভাবে অনার্স শেষ করে মাস্টার্সের পরীক্ষা দিলেও প্রায় এক বছর পর চূড়ান্ত ফল হাতে আসে। পাঁচ বছরের কোর্স সম্পন্ন করতে মোট সময় ব্যয় হয়েছিল আট বছর!
এই সমস্যাসমূহ কাটিয়ে ওঠা কষ্টকরই বটে। তারপরও আমরা আশাবাদী যে সমস্যা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে দেশের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশটুকু প্রতিফলিত হবে। ভবিষ্যতে র‍্যাঙ্কিং নির্ণয়ে আমাদের দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে থাকবে।

*ব্যাংকার