বন কোকিলের কথা

পটিয়ার সেই বন কোকিল ষ ছবি: মীর মনিরুল হক
পটিয়ার সেই বন কোকিল ষ ছবি: মীর মনিরুল হক

পাখিটিকে আমি যতবার দেখেছি, প্রতিবারই সে ঝোপঝাড়ের ভেতরে ছিল। আমাদের সাড়া পেয়ে উড়াল দিয়ে আশপাশের গাছের ডালে বসেছে। তাকে গেছো সাপ পাকড়াও করার একটা অভিনব দৃশ্য আমরা দেখেছিলাম ১৯৭৫ সালে—কাপ্তাই লেক থেকে মাইল দুয়েক দূরের একটা ছোট পাহাড়ের পাদদেশে।
সরু লিকলিকে সাপটি একটি গাছের সরু ডাল পেঁচিয়ে ধরে পাখিটির আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছিল প্রবল বিক্রমে। আর পাখিটি সাপের সরু মাথা মুখে পুরে সুকৌশলে সাপটির প্যাঁচ খুলে ফেলতে চাইছিল। ডানা ঝাপটাচ্ছিল, শক্ত-বক্র ঠোঁটে ধরা সাপের মাথাটি টেনে রেখেছিল টান টান করে। আমি ও আমার অফিস-বন্ধু বিদ্যুৎ প্রকৌশলী বেশ কাছ থেকে দেখেছিলাম দৃশ্যটা—মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাপটিকে ডাল থেকে খসাতে পারেনি সেই পাখিটি।
১৯৭৫-৮০ সাল। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ওই বন্ধুর সুবাদে পাঁচ বছরে ১১ বার কাপ্তাই লেক ও আশপাশের এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলাম আমি।
পাখিটিকে চিনি, নাম জানি না। আমাদের বাগেরহাট এলাকায় পাখিটির কোনো নামও নেই। বাল্য-কৈশোরে নজরে পড়েছে ক্বচিৎ।
পাখিটিকে সর্বশেষ দেখলাম এ বছরই, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর একটা গহিন চরে বেড়াতে যাওয়ার পথে। ছবি তোলা যায়নি। এত দিনে পাখিটির পরিচয় অবশ্য জেনে গেছি আমি।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী গ্রাম দৌলতপুর থেকে এই পাখির একটি ছবি তুলে আমার কাছে পাঠান মীর মনিরুল হক। এই পাখির ছবি আমার সংগ্রহে ছিল না।
লম্বা লেজের এই পাখিটির নাম বন কোকিল। ইংরেজি নাম Green-Billed Malkoha। বৈজ্ঞানিক নাম phaenicophaeus tristis। সর্বমোট মাপ ৫১ সেন্টিমিটার।
স্বভাবে কুকোর মতো—দেখতেও অনেকটা একই ধরন-গড়নের, লেজটা তুলনামূলকভাবে বেশি লম্বা। লেজ-পিঠ নীলচে ধূসর, চওড়া লেজের ডগা ও প্রান্তদেশে সাদা রং মাখানো। বুক-পেট-ঘাড়-গলা ধূসর ছাই। কালচে পা, সবুজাভ ঠোঁট। চোখের ওপরে যেন লাল কাজল লেপটানো।
বুদ্ধিমান-সাহসী-লড়াকু তথা গেরিলা স্বভাবের পাখি এরা। গিরগিটি-নির্বিষ সাপ-ব্যাঙ-তক্ষক ইত্যাদি পাকড়াও করতে এরা যথেষ্ট কৌশল খাটায়। পায়ের ব্যবহার এরা ভালোই জানে। পোকা-পতঙ্গ-ছোট পাখি ও পাখির ডিম-ছানাও খায় এরা। এদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, শরীর না নাড়িয়ে শুধু লেজটা নাড়াতে পারে।
কোকিল গোত্রীয় পাখি হয়েও এরা বাসা বানায় নিজেরা—গাছের ডালে কাঠি-ডালপালা দিয়ে। ডিম পাড়ে দু-তিনটি।
নিরীহ পক্ষীসমাজে এরা ‘ডাকাত’খ্যাত হলেও নিজেদের বাসার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেয় না অন্য কোনো পাখিকে। পাহাড়ি বন ও প্রাকৃতিক বনগুলোতেই বেশি দেখা যায় এদের।