সুন্দরবনের নীল বাঘ

নীল বাঘ। ছবিটি সুন্দরবনের করমজল থেকে তোলা ছবি: লেখক
নীল বাঘ। ছবিটি সুন্দরবনের করমজল থেকে তোলা ছবি: লেখক

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএস (কৃষি) চূড়ান্ত পর্বের ছাত্রদের একটি দল নিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণে গিয়েছিলাম ২০১০ সালের ডিসেম্বর। দুপুর নাগাদ গিয়ে পৌঁছাই সুন্দরবনের করমজলে। প্রথমেই ছাত্রদের কুমির ও হরিণ প্রজননকেন্দ্র ঘুরিয়ে দেখালাম। এরপর দুজন ছাত্রকে নিয়ে হরিণ প্রজননকেন্দ্রের পেছনের জঙ্গলে বাঘের পায়ের ছাপের ছবি তুলতে গেলাম। ফেরার পথে পুকুরপাড়ে পেলাম কুমিরের দেখা। পুকুরঘাটের পাশে বেশ বড় একটা ঝোপ। বিভিন্ন ধরনের বুনো ফুলে ছেয়ে আছে। আর সেই ঝোপেই দেখা হয়ে গেল নীল বাঘের সঙ্গে! শুনে খানিকটা খটকা লাগছে, তা লাগারই কথা; নীল রঙের আবার বাঘ হয় নাকি? অবশ্যই হয়। তবে তা কোনো স্তন্যপায়ী বাঘ নয়। অমেরুদণ্ডী এক বাঘ। সুন্দরবনেই ওর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। পরে অবশ্য অন্য অনেক বন-বাগানেই এর দেখা পেয়েছি। এতক্ষণ যার কথা বললাম, সে এ দেশের অতি সুন্দর এক প্রজাপতি। ‘নীল ডোরা’, আমি বলি ‘নীল বাঘ’ (Blue Tiger)। অধ্যাপক শফিক হায়দার ও মনোয়ার হোসেনের ফিল্ড গাইড অনুযায়ী ‘হিমলকুচি’। নীল ডোরা ‘ডানাইডি’ পরিবারের সদস্য। বৈজ্ঞানিক নাম Tirumala limniace exuticus। নীল ডোরা মাঝারি আকারের প্রজাপতি। প্রসারিত অবস্থায় ডানা ৯০ থেকে ১০০ মি.মি.। নীল ডোরা পরিযায়ী স্বভাবের। বাংলাদেশের সব এলাকায়ই দেখা যায়। তবে গভীর জঙ্গল এবং শুকনো ও বৃষ্টিপাতহীন এলাকা এরা পছন্দ করে না। সারা বছর দেখা গেলেও বর্ষা ও শরতেই বেশি চোখে পড়ে। এরা ধীরগতির প্রজাপতি হলেও প্রয়োজনের সময় বা বিরক্ত হলে অত্যন্ত দ্রুতগতিতেও উড়তে পারে।

নীল বাঘ কালো ও নীল রঙের প্রজাপতি। নীল ডোরার সামনের ডানার কোষগুলো হালকা নীল। অবশ্য পেছনের ডানার কোষগুলোর এই নীল রং আরও হালকা। আর কালো শিরাগুলো বেশ মোটা ও স্পষ্ট। তবে কালোর ওপর সাদা ফোঁটার এই কারুকাজ প্রজাপতিটির পেট, বুক ও মাথায় আছে। এরা বিষাক্ত প্রকৃতির প্রজাপতি। দেহ ও ডানার উজ্জ্বল রঙের মাধ্যমে এরা সহজেই শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পায়।

স্ত্রী নীল ডোরা নির্দিষ্ট গাছের পাতার নিচের প্রান্তে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা পাতাপ্রতি একটি। ডিম আকারে লম্বাটে ও কাঁটাযুক্ত। এগুলোর রং রুপালি-সাদা ও চকচকে। ডিম ফুটে শূককীট বের হতে চার দিন সময় লাগে। শূককীট বের হয়ে প্রথমেই ডিমের খোসাটি খেয়ে ফেলে। এর পর থেকে পাতা খেয়েই বড় হয়। শূককীট দুই সপ্তাহ পর মূককীটে পরিণত হয়। আর মূককীট অবস্থায় দুই সপ্তাহ থাকার পর একদিন সকালে খোলস কেটে পূর্ণবয়স্ক ‘নীল বাঘ’ বের হয়ে আসে। এরা দুই থেকে আট সপ্তাহ পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়ার অন্য অনেক দেশেই নীল ডোরার দেখা মেলে। হিমালয় পর্বতের দুই হাজার মিটার উঁচুতেও এদের দেখা যায়।