কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ

আবদুল কাদের মোল্লা
আবদুল কাদের মোল্লা

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এটিই মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের প্রথম রায়।

প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আপিলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে আজ মঙ্গলবার কয়েক মিনিটে এ রায় দেন। বেঞ্চের বিচারপতিরা হলেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

আসামি ও সরকার—উভয় পক্ষের দুটি আপিলের ওপর ৩৯ কার্যদিবস শুনানি শেষে গত ২৩ জুলাই আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। শুনানি শেষ হওয়ার ৫৫ দিনের মাথায় গতকাল সর্বোচ্চ আদালত চূড়ান্ত রায় দেন।

সকাল সাড়ে নয়টার দিকে এজলাসে আসেন বিচারপতিরা। আসন গ্রহণের পর কয়েক মিনিটে রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন। এ ক্ষেত্রে কাদের মোল্লাকে দোষী সাব্যস্ত করার ব্যাপারে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি একমত হলেও মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে এক বিচারপতি ভিন্নমত দেন। তবে সংক্ষিপ্ত আদেশে তা জানানো হয়নি।

রায়:

আদালত বলেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকারের করা আপিল গ্রহণযোগ্য। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সরকারের আপিল মঞ্জুর করা হলো। চতুর্থ অভিযোগ (ঘাটারচর ও ভাওয়াল খানবাড়ি হত্যাকাণ্ড) থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আসামিকে খালাস দিয়েছেন, রায়ের এ অংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে বাতিল করা হলো। এ অভিযোগে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো। ষষ্ঠ অভিযোগে (সপরিবারে হযরত আলী লস্কর হত্যা ও ধর্ষণ) সংখ্যাগরিষ্ঠ (৪: ১) মতামতে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে ঝুলানো হবে। সর্বসম্মতিক্রমে কাদের মোল্লার করা আপিল খারিজ করা হলো। তাঁর বিরুদ্ধে আনা ষষ্ঠ অভিযোগ সর্বসম্মতিতে গ্রহণযোগ্য। আর প্রথম (পল্লব হত্যাকাণ্ড), দ্বিতীয় (সপরিবারে কবি মেহেরুননিসা হত্যা), তৃতীয় (সাংবাদিক আবু তালেব হত্যাকাণ্ড) ও পঞ্চম অভিযোগে (আলুব্দী হত্যাযজ্ঞ) ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ড সংখ্যাগরিষ্ঠ (৪: ১) মতামতে বহাল রাখা হলো। রায় ঘোষণার পর সংক্ষিপ্ত রায়ের অনুলিপি চেয়ে গতকাল বিকেলেই সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় কাদের মোল্লার পক্ষে একটি আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের রায়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন। পঞ্চম অভিযোগ হলো: মিরপুরের আলুব্দী গ্রামে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ এবং ষষ্ঠ অভিযোগ হলো হযরত আলী, তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা ও ধর্ষণ। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযোগে তাঁকে ১৫ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এসব অভিযোগ হলো: পল্লব হত্যা, কবি মেহেরুননিসা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যা। চতুর্থ অভিযোগ (কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর ও ভাওয়াল খানবাড়ি হত্যাকাণ্ড) থেকে তিনি খালাস পান।

ষষ্ঠ অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড

ষষ্ঠ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। এ অভিযোগে আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ষষ্ঠ অভিযোগ (সপরিবারে হযরত আলী লস্কর হত্যা ও ধর্ষণ): একাত্তরের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ছয়টার দিকে কাদের মোল্লা, তার সহযোগী অবাঙালি বিহারি ও কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মিরপুরের ১২ নম্বরে ৫ নম্বর কালাপানি লেনে হযরত আলী লস্করের বাসায় যান। সেখানে হযরত আলী ও তাঁর স্ত্রী আমিনাকে গুলি করে, দুই মেয়ে খাদিজা ও তাহমিনাকে জবাই করে এবং দুই বছরের ছেলে বাবুকে মাটিতে আছড়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এরপর হযরত আলীর ১১ বছরের এক মেয়ে কাদের মোল্লার ১২ সহযোগীর গণধর্ষণের শিকার হয়। ওই সময় ঘটনাস্থলে লুকিয়ে থাকা হযরতের আরেক মেয়ে মোমেনা এই নৃশংসতার প্রত্যক্ষদর্শী। ওই ঘটনার সমর্থনে রাষ্ট্রপক্ষ মাত্র একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়। মোমেনা ওই পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য ও হযরত আলীর মেয়ে। বাসার ভিতরে ওই ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে বাইরের কারও পক্ষে ওই ঘটনা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব ছিল না। একাত্তরে মাত্র ১৩ বছর বয়সী সদ্যবিবাহিত মোমেনা ট্রাইব্যুনালে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে ক্যামেরা ট্রায়ালে ওই হূদয়বিদারক ঘটনার বিবরণ দেন।

চার অভিযোগে দণ্ড বহাল

প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযোগে কাদের মোল্লার ১৫ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। এই রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। প্রথম অভিযোগ (পল্লব হত্যাকাণ্ড): মুক্তিযুদ্ধকালে কয়েকজন স্বাধীনতাবিরোধী মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে নবাবপুর থেকে আটক করে মিরপুর ১২ নম্বরে নিয়ে যায়। কাদের মোল্লার নির্দেশে পল্লবকে সেখান থেকে টেনেহিঁচড়ে প্রথমে মিরপুর ১ নম্বরে শাহ আলী মাজার পর্যন্ত এবং পরে আবার টানতে টানতে মিরপুর ১২ নম্বরে ঈদগাহ মাঠ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পল্লবকে একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। একাত্তরের ৫ এপ্রিল আসামির অন্যতম সহচর আখতার ও অন্যরা পল্লবকে গুলি করে হত্যা করে। দ্বিতীয় অভিযোগ (সপরিবারে কবি মেহেরুননিসা হত্যা): একাত্তরের ২৭ মার্চ আসামি কাদের মোল্লা তাঁর সহযোগীদের নিয়ে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে কবি মেহেরুননিসার বাসায় যান। সেখানে তাঁরা মেহেরুননিসা, তাঁর মা এবং দুই ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। তৃতীয় অভিযোগ (সাংবাদিক আবু তালেব হত্যাকাণ্ড): একাত্তরে ২৯ মার্চ বিকেলে সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব মিরপুর ১০ নম্বরে তাঁর আগুনে পোড়া বাড়ি দেখতে যান। সেখান থেকে তিনি আরামবাগ যাওয়ার জন্য মিরপুর ১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে গেলে কাদের মোল্লা ও তাঁর আলবদর-রাজাকার সহযোগীরা তাঁকে আটক করে জল্লাদখানা পাম্পহাউসে নিয়ে যায়। সেখানে আবু তালেবকে জবাই করে হত্যা করা হয়।

পঞ্চম অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। এ রায় আপিল বিভাগ বহাল রেখেছেন। পঞ্চম অভিযোগ (আলুব্দী হত্যাযজ্ঞ): একাত্তরের ২৪ এপ্রিল ভোর সাড়ে চারটার দিকে আসামি কাদের মোল্লা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে মিরপুরের পল্লবী এলাকার আলুব্দী গ্রামে গিয়ে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। ওই হত্যাযজ্ঞে ৩৪৪ জন নিরস্ত্র গ্রামবাসী মারা যান।

চতুর্থ অভিযোগে যাবজ্জীবন

চতুর্থ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে খালাস দেন। এটা বাতিল করে আপিল বিভাগ তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। চতুর্থ অভিযোগ (ঘাটারচর ও ভাওয়াল খানবাড়ি হত্যাকাণ্ড): একাত্তরের ২৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত কাদের মোল্লা ও ৬০-৭০ জন রাজাকার ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানার খানবাড়ি এবং ঘাটারচর গ্রামে যান। সেখানে তাঁরা দুজন নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণি ও গোলাম মোস্তফাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এ ঘটনার পরপরই কাদের মোল্লা ও তাঁর সহযোগীরা ভাওয়াল খানবাড়ি এবং ঘাটারচরে হামলা চালান এবং নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করেন।

ঘটনা প্রবাহ: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। এ রায়ের পর তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তরুণ সমাজের ডাকে শাহবাগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। পরে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সমান সুযোগ রেখে ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) সংশোধন বিল, ২০১৩ জাতীয় সংসদে পাস হয়। আগে আইনে সরকারের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ ছিল না। গত ৩ মার্চ সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। আর সাজা থেকে অব্যাহতি চেয়ে পরদিন আপিল করেন কাদের মোল্লা। গত ১ এপ্রিল থেকে শুনানি শুরু হয়।

রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান শুনানিতে অংশ নেন। আসামিপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক ও খন্দকার মাহবুব হোসেন। তাদের সহায়তা করেন আইনজীবী শিশির মুনির।

আপিল শুনানিকালে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইগত প্রশ্ন ওঠায় ২০ জুন আপিল বিভাগ অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের আইনি সহায়তাকারী) হিসেবে জ্যেষ্ঠ সাত আইনজীবীর নাম ঘোষণা করা হয়। তাঁরা হলেন: টি এইচ খান, রফিক-উল হক, এম আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আজমালুল হোসেন কিউসি ও এ এফ হাসান আরিফ।

প্রশ্ন দুটি হলো—দণ্ড ঘোষণার পর আইনে আনা সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর অধীনে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে কি না? অ্যামিকাস কিউরিরা ৮ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত মতামত দেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে আনা সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে বলে মত দেন রফিক-উল হক, এম আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও আজমালুল হোসেন কিউসি। সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বলে মত দেন টি এইচ খান এবং এ এফ হাসান আরিফ।

প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ প্রশ্নে রফিক-উল হকের মত, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় এবং ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন (কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল) প্রয়োগের সুযোগ নেই। এম আমীর-উল ইসলাম প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের পক্ষে মত দেন। ১৯৭৩ সালের ট্রাইব্যুনাল আইনে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিফলন রয়েছে বলে মত দেন রোকনউদ্দিন মাহমুদ।

মাহমুদুল ইসলাম বলেন, সাধারণভাবে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে না। একই ধরনের মত দিয়ে আজমালুল হোসেন বলেন, বিচারের ক্ষেত্রে এ আইনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইন সাংঘর্ষিক হলে দেশীয় আইনই প্রাধান্য পাবে।

টি এইচ খানের মত হলো, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে। তবে দেশীয় আইনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন সাংঘর্ষিক হলে সে ক্ষেত্রে দেশীয় আইন প্রাধান্য পাবে। প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে বলে মত দেন হাসান আরিফ।

এদিকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। সাড়ে আটটা থেকেই একে একে এজলাস কক্ষের দিকে জড়ো হতে থাকেন আইনজীবীরা। সকাল পৌনে নয়টা থেকে একে একে উভয় পক্ষের আইনজীবীসহ আইনজীবীরা এজলাস কক্ষে জড়ো হতে থাকেন।