বিরল রাম কোটা

কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে গাছের ডালে রাম কোটা ষ ছবি: লেখক
কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে গাছের ডালে রাম কোটা ষ ছবি: লেখক

প্রথম দেখেছিলাম ১৯৮৭ সালে ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানার খাঁচায়। বুনো পরিবেশে প্রথম সাক্ষাৎ মালয়েশিয়ায় ‘Taman Buaya Melaka’ বা ‘মেলাকা কুমির খামার’-এর একটি বড় গাছে। তবে জায়গাটা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকায় ভালো ছবি তুলতে পারিনি। গত এক বছরে দুবার বন্য প্রাণী গবেষক তানিয়া খান ও ফরেস্ট অফিসার মুনির খানের সঙ্গে আদমপুরে ওদের খুঁজেছি কিন্তু পাইনি; যদিও মুনির ভাই আদমপুরে তাদের ছবি তুলেছেন।
এ বছরের ১৫-১৬ মার্চ তাদের দেখলাম রেমা-কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে। বিরল ও দুর্লভ পাখির সন্ধানে সফরসঙ্গী শিপলু, রেজা ও রাসেলকে নিয়ে ঘুরছি। এক জোড়া ধনুক প্রজাপতি দেখে পিছু নিলাম। ওদের পেছনে ছুটতে ছুটতে মোটাসোটা একটা গাছের পাশে এসে থমকে দাঁড়ালাম। সবাইকে ইশারায় দাঁড়াতে বললাম। আঙুল দিয়ে দেখালাম, কীভাবে ওই গাছের একটা ডালে চার হাত-পা ও লেজ ছড়িয়ে সে ঘুমাচ্ছে। একটা ভালো অবস্থানে যাওয়ার জন্য নিঃশব্দে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। একটু কাছাকাছি যেতেই সে চোখ খুলে ড্যাব ড্যাব করে তাকাল। তবে আমাদের পাত্তা দিল না; একইভাবে শুয়ে থাকল। পটাপট দুটি ক্লিক। এরপর সে উঠে দাঁড়াল। খানিকক্ষণ এডাল-ওডাল ছোটাছুটি করল। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকল। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কীর্তিকলাপ দেখলাম। মন-প্রাণ-চোখ জুড়িয়ে গেল।
এতক্ষণ যার কথা বললাম, সে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় কাঠবিড়ালি ‘রাম কোটা’। ‘বৃহৎ কাঠবিড়ালি’ (Black Giant or Malayan Giant Squirrel) নামেও পরিচিত। Sciuridae পরিবারভুক্ত এই স্তন্যপ্রায়ী প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Ratufa bicolor।
রাম কোটা লম্বায় এক মিটারের বেশি। মাথা-দেহ ৪২ সেন্টিমিটার ও লেজ ৬০ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় দুই কেজি। দেহের ওপরটা গাঢ় বাদামি থেকে কালো। গাল, গলা, বুক-পেট ও চার হাত-পায়ের ভেতরের দিকটা হালকা হলুদ বা সাদা। লম্বা ঝোপালো লেজটা কালো। কান দুটো বেশ বড় ও কালো। কানে গোছার মতো চুল থাকে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের মিশ্র চিরসবুজ বন ও রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকাতে আছে। বৃক্ষবাসী প্রাণীটি সহজে মাটিতে নামে না। বেশ লাজুক এবং ভীতুও। দিনের বেলা সক্রিয় থাকে। সাধারণত একাকী থাকে, কখনোবা জোড়ায় দেখা যায়। উঁচু ও কাঁপা কাঁপা স্বরে ‘চুড-চুড-চুড’ স্বরে ডাকে। বিভিন্ন ধরনের ফল, পাতা, অঙ্কুর ও গাছের ছাল খায়। ফলের বীজ ছড়িয়ে বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
এরা বিভিন্ন গাছে একাধিক বাসা বানায়। পাতা ও ছোট ছোট কাঠি জড়ো করে বড় ও গোলগাল বাসা গড়ে। বাসার ভেতরে অন্দরমহলও থাকে। আর ঢোকার পথ থাকে এক পাশে।
মার্চ-সেপ্টেম্বর প্রজননকাল। স্ত্রী রাম কোটা ৩২ দিন গর্ভধারণের পর প্রায় ৭৫ গ্রাম ওজন ও ২৩ সেন্টিমিটার লম্বা একটি বাচ্চার জন্ম দেয়। তবে কদাচ দুটি বাচ্চাও হতে পারে। স্ত্রী বছরে দুবার বাচ্চা দেয়। বাচ্চারা প্রায় তিন বছর বয়সে যৌবনপ্রাপ্ত হয়। বুনো পরিবেশে এরা কত বছর বাঁচে, তার কোনো তথ্য জানা না গেলেও আবদ্ধাবস্থায় ১৯ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। বর্তমানে এদেরকে অপ্রতুল তথ্য শ্রেণীতে রাখা হয়েছে। বিশ্বে এরা প্রায় বিপদগ্রস্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বেই দিনে দিনে এদের সংখ্যা কমছে। বন ধ্বংসের কারণে আবাস এলাকা কমে যাওয়াই এর মূল কারণ। কাজেই বিরল রাম কোটা যেন এ দেশ থেকে হারিয়ে না যায়, সে জন্য সরকার ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞদের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে বইয়ের পাতা ছাড়া আর কোথাও এদের দেখা মিলবে না।