যেভাবে গড়ে উঠল #MeToo

মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো। ছবি: এএফপি
মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো। ছবি: এএফপি

হঠাৎ করেই বদলে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পর্দা। ঢুঁ মারলেই দেখা যাচ্ছে হ্যাশট্যাগ মি টুও (#MeToo) লেখা। বিশেষ করে নারীদের ওয়ালে। প্রশ্ন জাগতে পারে, কী হলো? বেশির ভাগ নারীই কেন এটা লিখেছেন? কিছুসংখ্যক পুরুষও আছেন এই তালিকায়। তাই জানিয়ে রাখা ভালো, এটি যৌন নিপীড়ন বিরোধী একটি প্রচারণা। এর শুরুটা করেছেন মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো। হলিউডের মুভি মুঘল হার্ভে উইনস্টেইনের যৌন কেলেঙ্কারির খবর ফাঁসের প্রতিক্রিয়ায় তাঁর এই উদ্যোগ।

হার্ভে উইনস্টেইন গত তিন দশকে অনেক নারীকে যৌন হয়রানি করেছেন বলে নিউইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি খবর প্রকাশ করে। এই তালিকায় আছেন হলিউডের জনপ্রিয় তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, গিনেথ প্যাল্ট্রো, অ্যাশলে জুড, কারা ডালাভিনেন, কেট বেকিনসেল, লি সিডু, হিথার গ্রাহাম ও ইতালীয় অভিনেত্রী আসিয়া আর্জেন্তোওসহ আরও অনেকে। এ খবর প্রকাশের পর অভিনেত্রী রোজ ম্যাকগোয়ান টুইট করে বলেন, তিনিও এই প্রভাবশালী প্রযোজকের কাছে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। এরপর টুইটার সাময়িকভাবে তাঁর অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেয়। প্রতিবাদে বিশ্বের অনেক নারী ঘোষণা দিয়ে একদিনের জন্য টুইটার বর্জন করেন।

তবে অ্যালিসার মনে হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শক্তিকে ব্যবহার করে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। কারণ, শুধু এই অভিনেত্রীরাই নন; যৌন নিপীড়নের বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন এমন সাধারণ নারীর সংখ্যাও নেহাত কম হবে না। ১৫ অক্টোবর রাতে তিনি টুইট করেন, ‘যারা যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির শিকার হয়েছেন, তারা মি টুও লিখে টুইটের রিপ্লাই দিন।’

এই ধারণা অ্যালিসা তাঁর এক বন্ধুর কাছে পান। বন্ধু তাঁকে লেখেন, ‘যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির শিকার নারীরা যদি তাদের স্ট্যাটাসে মি টুও লেখেন, তাহলে আমরা এই সমস্যার প্রকটতা সম্পর্কে মানুষকে একটা ধারণা দিতে পারব।’ বন্ধুর এই বার্তা হুবহু তুলে দিয়ে নিচে মি টুও লিখে টুইট করেন তিনি। এরপরের ঘটনা তো ইতিহাস!

অ্যালিসার প্রথম টুইট, যার মাধ্যমে তিনি যৌন নিপীড়ন বিরোধী প্রচারণা শুরু করেন।
অ্যালিসার প্রথম টুইট, যার মাধ্যমে তিনি যৌন নিপীড়ন বিরোধী প্রচারণা শুরু করেন।

অ্যালিসার টুইটের মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ তাতে কমেন্ট করেন। হাজার হাজার নারী মি টুও লিখে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন। টুইটার বলছে, দুই দিনে ১০ লাখের বেশিবার এই হ্যাশট্যাগ দিয়ে টুইট করা হয়েছে। পিছিয়ে নেই ফেসবুক ব্যবহারকারীরাও। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলছে, অ্যালিসা এই প্রচার শুরুর ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বিষয়টি নিয়ে পোস্ট দিয়েছে ও কমেন্ট করেছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ৪৫ শতাংশ এই প্রচারণায় শামিল হয়েছে। যত সময় গড়াচ্ছে, যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া মানুষের এই প্রচারণার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে।

এত বিপুল মানুষের সাড়া পেয়ে বিস্মিত অ্যালিসা মিলানো। মার্কিন সাপ্তাহিক ভ্যারাইটিকে তিনি বলেন, ‘বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। তবে আমার মনে হয়, আমি শুধু সঠিক সময়ে বিষয়টি তুলে ধরে নৌকার পালে হাওয়া দিয়েছি। এরপর নৌকা নিজেই চলছে। আর এতে যে পরিবর্তনটা হচ্ছে, সেটা সত্যিই বিশেষ কিছু।’ বিশ্বব্যাপী যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এমন বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া মানুষের সংখ্যাটা আমাকে অবাক করেনি। আমি অবাক হয়েছি, কত লাখ লাখ মানুষ লজ্জায়, সংকোচে কিংবা ভয়ে এসব কথা প্রকাশ করতে পারেনি। পাছে যদি তাদের গায়েই খারাপের তকমা লাগে!’

অ্যালিসা এই প্রচারকে শুধু ‘হ্যাশট্যাগ আন্দোলন’ বলতে নারাজ। কিংবা এটা শুধু হলিউডের বিষয়-এটাও মানতে চান না তিনি। তাঁর ভাষায়, এটা প্রতিদিনের-প্রতি মুহূর্তের ঘটনা। বিশ্বের এ প্রাপ্ত থেকে ও প্রান্ত-সবখানের ঘটনা। এই প্রচারের মধ্য দিয়ে আসলে সমস্যাটা কতটা তীব্র আর গভীর, তা সবার সামনে এল। এখন একটা সমাধান দরকার। যৌন নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিকে দোষারোপ নয়। বরং অভিযোগের আঙুল উঠুক যৌননিপীড়কের দিকে। লজ্জা বা গ্লানি কোনোভাবেই ঘটনার শিকার ব্যক্তির নয়, বরং নিপীড়কের-এই চর্চা সমস্যার সমাধানে অনেকটা পথ এগিয়ে দেবে।

অ্যালিসা কিন্তু হুট করে অধিকারকর্মী বনে যাননি। পারিবারিক সংস্কৃতি ও জীবনবোধের মধ্যেই তিনি লালন করেন অন্যের জন্য কিছু করার তাগিদ। তাঁর জন্ম নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে ১৯৭২ সালের ১৯ ডিসেম্বর। বাবা থমাস মিলানো চলচ্চিত্রের সংগীত নিয়ে কাজ করতেন। আর তাঁর মা লিন মিলানো একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়। মিলানো পরিবারের পূর্বপুরুষেরা ইতালির। জন্মসূত্রেই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদের ধারণার সঙ্গে পরিচিত তিনি।

মাত্র সাত বছর বয়সে শিশুশিল্পী হিসেবে নাটকে কাজ করেন অ্যালিসা। ১৯৮৪ সালে ১২ বছর বয়সে ‘ওল্ড এনাফ’ নামের একটি চলচ্চিত্র দিয়ে হলিউডে যাত্রা করেন। ওই বয়সে তিনি কমান্ডো চলচ্চিত্রে আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়ান। ৩০টির মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। নাম কুড়িয়েছেন নাটকে অভিনয় করেও। এক সময় গান গাইতেন, অ্যালবামও বের হয়েছিল। তবে পরে ঘোষণা দিয়ে গান থেকে অবসর নেন। প্রযোজনার সঙ্গেও যুক্ত আছেন।

ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পর পুরুষদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে অ্যালিসার দ্বিতীয় টুইট।
ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পর পুরুষদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে অ্যালিসার দ্বিতীয় টুইট।

আশির দশকের শেষের দিকে অধিকারকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময় তাঁর এক খুদে ভক্ত এইডস আক্রান্ত হয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ দেখান। অ্যালিসা খুদে ভক্তকে নিরাশ করেননি। তিনি তার কাছে যান, অনেকটা সময় কাটান। ভক্তদের বলেন, এইডস কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। আক্রান্তদের প্রতি ভালোবাসা-সহমর্মিতা দেখাতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ২০০৪ সালে তিনি এইডস নিয়ে ইউনিসেফের কার্যক্রমে যোগ দেন। দক্ষিণ আফ্রিকার এইডস আক্রান্ত নারী ও শিশুদের জন্য তহবিল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। ছিলেন ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত। ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার।

যৌন নিপীড়ন ৪৪ বছর বয়সী অ্যালিসার সুখী জীবনে বাধা হতে পারেনি। টাইমকে তিনি বলেছেন, যৌন নিপীড়নের দায় কোনোভাবেই ভুক্তভোগীর ওপর বর্তায় না। বর্তানো উচিত না। কারণ, এটা ভুক্তভোগীর সমস্যা নয়। তিনি শুধু বিকৃত মানসিকতার মানুষের নোংরামির শিকার। এ জন্য যদি মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, তবে সেটা যৌননিপীড়কেরই করা উচিত। তিনি নারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন—‘এমন ঘটনার জন্য কোনোভাবেই নিজেকে দোষী ভাববেন না। বরং প্রতিবাদ করুন। বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসুন দোষী ব্যক্তিকে।’

অনেক নারী অ্যালিসার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। মনের গহিনে লুকিয়ে রাখা কথাগুলো যে তাঁর কল্যাণেই বেরিয়ে এসেছে! একজন বলেছেন, ‘একটা পাথর সরে গেল। বহু বছর পাথরটা বুকের ওপর চাপা দিয়ে ছিল। মাঝে মাঝেই ভারী পাথরটা ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হতো। পরক্ষণেই মনে হতো—না, এটা করা যাবে না। তাহলে মানুষ যে আমাকেই খারাপ বলবে! আজ মনে হচ্ছে, আমি একা না। পৃথিবীর বহু মানুষ আমার মতো একই রকম বাজে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। জোলি থেকে আমি, আমরা অনেকেই। আজ আমরা যদি সবাই আওয়াজ তুলি, সবাই নড়েচড়ে বসবে। পরিবর্তন আনতে বাধ্য হবে। অ্যালিসার জন্য তাই ভালোবাসা।’

যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সৃষ্ট জনজোয়ার দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বসে নেই অ্যালিসা। গতকাল বুধবার রাতে এক টুইটে পুরুষদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘পুরুষ, যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির এমন মহামারি সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে আপনি নারীর জন্য কী করতে পারেন?’ জুড়ে দিয়েছেন হ্যাশট্যাগ হাউআইউইলচেঞ্জ (#HowIWillChange)। নারীকে এমন দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে এগিয়ে আসতে পারে পুরুষ। পুরুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কখনোই এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে না। এবার দেখার পালা, পুরুষেরা কী বলেন অ্যালিসার টুইটের জবাবে।