বিতাড়ন থেকে রেহাই মিলছে না অনেক বাংলাদেশিরও

যুক্তরাষ্ট্র থেকে অবৈধ ও কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর যেন মহোৎসব চলছে। এই ডিপোর্টেশন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি খড়্গ নামছে মেক্সিকোসহ অন্য দেশের অবৈধ নাগরিকদের ওপর। বাংলাদেশিদের ওপরও প্রভাব পড়ছে ভীষণভাবে। সর্বশেষ চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীকে ডিপোর্টেশন সেন্টারে পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পুলিশ—আইস।

একটি সূত্রে জানা গেছে, নিউজার্সির ডিপোর্টেশন সেন্টার দিয়ে গত চার মাসে ৪৯ জন বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ডিপোর্ট আদেশ থাকা মানুষেরা অভিজ্ঞ আইনজীবীর শরণাপন্ন হওয়ার পরও আইনি সুরক্ষা পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্ট অ্যাটর্নি, পারিবারিক নিকটাত্মীয় আর মূল ধারার গণমাধ্যমের সংবাদ বিশ্লেষণেই পাওয়া গেছে অভিবাসনের এমন ভীতিকর তথ্যাদি।

এ নিয়ে ম্যানহাটনের নেপালি বংশোদ্ভূত অ্যাটর্নি দিল্লীরাজ ভট্ট প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা অফিসের সঙ্গে আলাপকালে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘ইমিগ্রেশন আইনটির ব্যবস্থাপনা এরই মধ্যে পাগলা ঘোড়ায় পরিণত হয়েছে। কে কীভাবে এটির প্রয়োগ করছে, তার হিসাব কম। এটা খুবই বাজে একটা সময় সবার জন্য। যাদের কাগজপত্র আছে তাদের জন্য এটি একটি সমস্যাসংকুল সময় হলে যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদের সময়।’

একই মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশি আইনি পরামর্শক ও অভিবাসন অধিকারকর্মী মোহাম্মদ এন মজুমদার ও অ্যাটর্নি নাজমুল আলম সিদ্দিকীও।
এই প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছিল তখন সামাজিক গণমাধ্যমে মিশিগানের ডেট্রয়েটের একজন বাসিন্দা জর্জ গ্রাসিয়ার ডিপোর্টেশনের সময় বিমানবন্দরে পরিবার থেকে তাঁর চিরতরে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ছবিসংবলিত সংবাদ ভেসে বেড়াচ্ছিল। ডেট্রয়েট প্রেস অনলাইনের সংবাদে বলা হচ্ছে গ্রাসিয়া ৩০ বছর ধরে এই দেশে বসবাস করছিলেন। মার্টিন লুথার কিং দিবসের দিনেই তাঁকে ফেরত যেতে হচ্ছে মাত্র নয় বছর বয়সে ছেড়ে আসা তাঁর দেশ মেক্সিকোতে। একই ধরনের একটি অভিজ্ঞতা হয়েছে হিলসাইডের বাসিন্দা আকরাম হোসেনেরও (ছদ্মনাম)।
অনুসন্ধানে জানা যায়, হিলসাইডের বাসিন্দা আকরাম ২৮ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছিলেন। শুরুর দিকে তিনি এক মার্কিন নাগরিককে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু সেই সংসার না টেকায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেন ওই নারী। কিন্তু আইনি সুরক্ষার জালে ছিলেন আকরাম। এরপর তিনি আবার বিয়ে করেন ও তিন সন্তানের জনকও হন। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নাগরিকত্ব আছে এই দেশে। অবশ্য অনেক আগে করা আকরামের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনটি নাকচ হয়ে যাওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে ডিপোর্টেশন আদেশ ছিল আদালতের। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, তাই আইনি সুরক্ষার মধ্যে থেকে প্রতিবছর তিনি ইমিগ্রেশন দপ্তর-আইসে হাজিরা দিয়ে কাটিয়েছেন গত ১০ বছর। তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল, যেহেতু তাঁর স্ত্রীর নাগরিকত্বের মাধ্যমে দুই বছর আগে আরেকটি স্থায়ী বসবাসের আবেদন করা হয়েছে এবং সেই মামলা লড়ছেন একজন ইহুদি আইনজীবী, সেহেতু তাঁর বিষয়টা সমাধান হয়ে যাবে। তাই বেশি প্রস্তুতি না নিয়ে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তিনি যখন নিয়মিত বার্ষিক হাজিরা দিতে যান ইমিগ্রেশন দপ্তরে, তখনই তাঁর কোনো কথা না শুনে তাঁকে ডিপোর্টেশনের জন্য নির্ধারিত নিউজার্সির ডিটেনশন সেন্টারের পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ দপ্তরের আদালত। সে সময় তাঁর সঙ্গে থাকা আইনজীবীর কোনো কথাই শোনেনি কর্তৃপক্ষ। এমনকি ওই আইনজীবীকেও বেশি কথা বললে তাঁর নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন আকরামের পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন। পরে ওই আইনজীবী নিজের অপারগতার কথা জানিয়ে বলেছেন, ‘আমি আমার ৩০ বছরের আইনচর্চায় এমন দুর্ব্যবহার এবং একরোখা সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হইনি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আইনি পরামর্শক (লিগ্যাল কনসালট্যান্ট) মোহাম্মদ এন মজুমদার বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় ট্রাম্প-সমর্থক আইস পুলিশ ও ইমিগ্রেশন বিচারকেরা নিজেরাই আইনের সবচেয়ে কঠোর দিকটি ব্যবহার করছেন। আমাদের দেশের আইনের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের বিধান চর্চা করা হতো এবং এত দিন ধরে তা হয়েছে। কিন্তু এখন সেটার অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। তারপরও অভিযুক্তরা যখন আদালতে এমন শুনানিতে যান, তখন তাঁর যে আইনের সুরক্ষা পাওনা আছে সেটি জেনে যাওয়া ভালো। আর অবশ্যই আইনজীবী ছাড়া আইনি এসব ঝামেলা মোকাবিলা করা মোটেই সমীচীন নয়।’
তবে যেহেতু আইনজীবীরাও তাঁদের পাঠ্যসূচি বা আইনচর্চায় এত দিন যেসব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছিলেন, সেগুলো ভূলুণ্ঠিত হওয়ায় অ্যাটর্নিরাও উদ্বিগ্ন। ভট্ট অ্যান্ড ভট্ট ল অফিসের প্রধান অ্যাটর্নি দিল্লীরাজ ভট্ট বলেন, ‘অ্যাটর্নিরা খুব ভালো সময় পার করছে এটা বলা যাবে না। কেননা, মানুষ আইনের সুরক্ষার বিষয়ে আশ্বস্ত হতে পারছে না। এমন অনেক বিষয় ঘটছে, যেটা আমরা আমাদের আইনচর্চায় ও মানবাধিকার সুরক্ষার কাজে আগে দেখিনি।’
বাংলাদেশি আমেরিকান অ্যাটর্নি নাজমুল আলম সিদ্দিকী প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘এখন ডিপোর্টেশন আদেশে বাছবিচার হচ্ছে কমই। মূলত ট্রাম্প তার সমর্থক গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রাখতে এবং ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে আগের প্রভাব বজায় রাখতেই তাঁর অ্যাজেন্ডা কঠোরভাবে পালন করছেন। তবে এর মধ্য দিয়ে যদি অন্য আইনি প্রক্রিয়া এবং কর্মক্ষেত্রনির্ভর (এইচ-ওয়ান বি/ইবি ওয়ান/ইবি ফাইভ) ভিসায় গ্রিন কার্ড দেওয়ার পথে যাওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে কিছু ভালো সম্ভাবনা আসতে পারে। অন্যথায় এই ডিপোর্টেশন খড়্গে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো যুক্তরাষ্ট্র’।
২০১৭ সালে প্রথম ধাপে ১১ জন বাংলাদেশিকে এবং পরের ধাপে আরও ২৭ জনকে ডিপোর্ট বা দেশে ফেরত পাঠানো হয়। যেহেতু এই ডিপোর্টেশন প্রক্রিয়াটি ঘটে দ্রুততায় এবং কাগজপত্রহীন ব্যক্তিদের সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার বিষয় থাকে, তাই অনেকেই বিষয়টি জানাতে চান না। সে কারণে খুব বেশি জানার সুযোগ থাকে না যে মোট কতজনকে এই প্রক্রিয়ায় দেশে পাঠানো হচ্ছে বা হয়েছে।
রিয়াজ তালুকদার নামের আরও এক ব্যক্তিকে দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ জারি করা হলে তিনি গণমাধ্যম আর স্থানীয় মানবাধিকারকর্মীদের দ্বারস্থ হন। এরপর তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রচারিত হয় এবং আন্দোলন জোরদার হয়। এ অবস্থায় ইমিগ্রেশন পুলিশের দপ্তর তাঁকে ছয় মাসের বাড়তি সময় দিয়ে আইনি প্রক্রিয়া শুরুর সুযোগ দেয়। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, রিয়াজ তালুকদারের পুরো আইনি প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু হয়েছে। তাঁর যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদনপত্র আবার শুনানির অপেক্ষায়। এটি সম্ভব হয়েছে আমেরিকার মূল ধারার গণমাধ্যমের সোচ্চার অবস্থান আর রিয়াজের পক্ষে হাজারো মানুষের সরব প্রতিবাদের কারণে। তবে সব প্রতিবাদ যে হালে পানি পায়, তাও নয়।
রাজীব রাগবীর ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর একজন নাগরিক। তিনি আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে ডিপোর্টেশন আদেশ পান। কিন্তু পরে আইনি লড়াই চালিয়ে সেই ডিপোর্টেশন আদেশ স্থগিত করতে পারেন তিনি। এরপর নিজেই একটি সংগঠন দাঁড় করান, উদ্দেশ্য এমন আইনি মারপ্যাঁচে পড়া ডিপোর্টেশন নির্দেশপ্রাপ্ত অভিবাসীদের হয়ে লড়াই করা। এই রাজীব রাগবীরকে আইস পুলিশ ধরে ডিপোর্ট করার জন্য ফ্লোরিডায় তাদের ডিটেনশন সেন্টারে পাঠিয়েছে ১০ জানুয়ারি। সেখানে এখন তাঁর ডিপোর্ট অর্ডার ঠেকানোর চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে। তাঁর দেশে ফেরা ঠেকানো গেলে সেটা হবে একটি ব্যতিক্রম ঘটনা।
এদিকে ৯ জানুয়ারি একযোগে যুক্তরাষ্ট্রের ৯৮টি সেভেন ইলেভেন স্টোরে গভীর রাতে অতর্কিতে হানা দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। ওই রাতে অভিবাসী-অধ্যুষিত প্রতিটি শহরে এ অভিযান চালানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল, কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের খুঁজে বের করা। ২১ জনকে নানা স্থান থেকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। নিউইয়র্কের অন্তত তিনটি স্টোরে সেদিন অভিযান চলেছে। এভাবে বাংলাদেশি মালিকানাধীন কয়েকটি রেস্তোরাঁ আর মুদি দোকানেও অভিযান চালানো হয়েছে ২০১৭ সালে। এ কারণে ভয় আর আতঙ্কে রয়েছেন কাগজপত্রহীন অভিবাসীরা। অথচ এসব মানুষ একসময় বিশ্বাস করতেন, যত দিন নিউইয়র্ক শহর আছে, তত দিন তাঁরা বাস করবেন এক অভয়ারণ্যে। কিন্তু সেই দিন উল্টে দিয়েছেন ট্রাম্প।
২০১৭ সালে আড়াই লাখ মানুষকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টম পুলিশ। এটাকে বড় সফলতা হিসেবে দেখছে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড বর্ডার পেট্রোল পুলিশ দপ্তর। কিন্তু এই সফলতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে বেশ করুণ আর বেদনাদায়ক অনেক গল্প, যে খড়্গ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না অনেক বাংলাদেশিও।