'পিতৃভূমি'র জন্য অনুভূতি নেই তাঁদের!

‘পিতৃভূমি’র জন্য কোনো অনুভূতি নেই প্রবাসী বাংলাদেশিদের নতুন প্রজন্মের। এমনকি সাত-আট বছর বয়সে আমেরিকায় এসে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিরাও দেশের কথা তেমন ভাবেন না। শুধু তা-ই নয়, এদের অধিকাংশই যেকোনো অনুষ্ঠানে, আড্ডায়, এমনকি নিজ ঘরে ইংরেজিতে কথা বলেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এমনকি খাবার তালিকা এদের অনেকেই লালন করেন না। এদের চিন্তা-চেতনায় বাংলাদেশ নেই। সে দেশের উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখার কথা তাদের মনেই আসে না।
এর ঠিক বিপরীত অবস্থা ভারতীয় ও পাকিস্তানিদের ক্ষেত্রে। এই দুই দেশের প্রবাসীদের তৃতীয় কিংবা চতুর্থ প্রজন্মও নিজ দেশের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। তারা তাদের স্বদেশের সাফল্যে গর্ববোধ করেন। পিতৃভূমির দুর্দিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
বাংলাদেশি নতুন প্রজন্ম কেন এর বিপরীতে অবস্থান করছেন, তা জানার জন্য আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বললে অনেক ধরনের যুক্তি সামনে আসে। তাদের মতে, এই বিচ্ছিন্নতার মূলে রয়েছে মানুষের স্বাভাবিক ও সহজাত মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা। আমেরিকার সুখী ও নিরাপদ জীবন, বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যা, নাজুক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনৈতিক সহিংসতা, দুর্নীতি সর্বোপরি এ ব্যাপারে মা-বাবার অনীহা নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে।
টেক্সাসের হিউস্টন প্রবাসী মোহাম্মদ হাসান ১৯৮৭ সালে আমেরিকায় আসেন। তার কাছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, ‘তারা দেশের কথা ভাববে কেন? তারা এখানেই জন্মেছে। এখানেই বড় হচ্ছে। দেশের কোনো স্মৃতি তাদের মনে নেই। তারা সবকিছু এখানেই গুছাচ্ছে। তারা এ দেশকে নিয়েই ব্যস্ত।’
প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাকে হাসান বলেন, ‘দেশের প্রতি তাদের অনুভূতি জন্মায়নি। তারা মা-বাবার কাছ থেকেও দেশের প্রতি ভালোবাসার কোনো প্রেরণা পাচ্ছে না। তাদের মা-বাবা দেশে তাদের জায়গা-জমি বিক্রি করছেন। তারাও চান না, তাদের সন্তানরা দেশে যাক, দেশের জন্য ভূমিকা রাখুক। নতুন প্রজন্মও মা-বাবার কাছ থেকে জানছে বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে। আর এই সবই তাদের মধ্যে বাংলাদেশ-বিমুখতার সঞ্চার করছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘মানুষের মনস্তত্ত্ব ও সহজাত প্রবৃত্তি হলো জন্মস্থানকে ভালোবাসা। যে স্থানে জন্ম নেয়, বড় হয়, সে জায়গার স্মৃতিই তার মনে দাগ কাটে। সে জায়গাকেই সে ভালোবাসে। আমেরিকায় জন্ম হওয়া নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশে তেমন কোনো স্মৃতি নেই। দু’চার দিনের জন্য বেড়াতে গেলেও তাদের অধিকাংশই সেখানে বৈরী পরিস্থিতি দেখেন। সুখকর অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ফেরেন না। মাতৃভূমির প্রতি মমত্ববোধ সৃষ্টি কিংবা গর্ব করার মতো কোনো উপাদানই তাদের সামনে নেই। সার্বিক পরিস্থিতিগত কারণে তারা বাংলাদেশের প্রতি বিমুখ।’
তবে নতুন প্রজন্মের এই স্বদেশ বিমুখতার পেছনে তাদের মা-বাবার দায়ও কম নয় বলে মনে করেন গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে মা-বাবারাও তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন না। সন্তানদের বাংলা ভাষায় শেখানো তো দূরের কথা, অনেকে তাদের সঙ্গে বাংলাও বলেন না। আমি এমন কিছু পরিবারের সন্তানদের দেখেছি, যারা এ যুক্তি দেখায় যে বাংলা না জানার কারণে দেশে বেড়াতে গেলেও তারা কারও সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। আত্মীয়-স্বজনদের কথাও বুঝবেন না। ফলে ফেলে আসা দেশই এখন তাদের কাছে বিদেশ হয়ে উঠছে।’
ব্রঙ্কস প্রবাসী মোহাম্মদ আলী আমেরিকায় এসেছেন ১৯৮২ সালে। নতুন প্রজন্মের স্বদেশ বিমুখতার কারণ হিসেবে তিনি বাংলাদেশ ও আমেরিকার সমাজের মধ্যে বিদ্যমান বিস্তর ফারাকের কথা তুলে ধরেন। তাঁর মতে, ‘এখানে শিশুকাল থেকেই নতুন প্রজন্ম আরাম-আয়াসে বড় হচ্ছে। তাদের বন্ধু-বান্ধব, সব স্মৃতি এখানেই। বাংলাদেশের সঙ্গে চিন-পরিচয় হবে, ভালোবাসা জন্মাবে এমন পরিস্থিতিও তো নেই। দেশ ভালো থাকলে দেশের আইন-শৃঙ্খলা, জীবনের নিরাপত্তা থাকলে সব পরিবারই ঘন ঘন দেশে যেত। কিন্তু এখন দেশে যাওয়ার কথা অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন। এমনকি পরিবেশও এমন অস্বাস্থ্যকর যে, রাজধানীতেই চারদিকে ধুলাবালি, ধোঁয়া ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধ। নতুন প্রজন্ম এ ধরনের পরিবেশ কল্পনাও করতে পারে না। বাচ্চাদের কথা ভেবে বাংলাদেশে না যাওয়াই এখন উত্তম বলে মনে করেন অনেকে। এমনও আছে তিন মাস থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে গিয়ে ১৫/২০ দিনের মধ্যেই ফিরে আসছেন।’
তিনি বলেন, ‘অবস্থা এমন হয়েছে যে, ৯৯ শতাংশ নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে আমেরিকাকে নিয়ে ভাবে, বাংলাদেশকে নিয়ে নয়। আর তাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভাববে তাদের পূর্ব-পুরুষেরা বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন। বাংলাদেশ আর অন্য দশটি দেশের মতো তাদের কাছে পরদেশ হয়ে যাবে।’
নিউইয়র্ক প্রবাসী হেলিম উদ্দিন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে দেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে নতুন প্রজন্ম তো বটেই, তাদের মা-বাবাও দিন দিন দেশের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। দেশ নিয়ে কোনো ইতিবাচক গল্প তাদের সমানে নেই। সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, সম্পত্তি বেদখল হওয়ার ঘটনা, দুর্নীতির কাহিনি মা-বাবার কাছ থেকেই তারা জানছে। এই অবস্থায় দেশের প্রতি দরদ হবে কীভাবে? এরা তো নেতিবাচক কাহিনি শুনেই বড় হচ্ছে। আমরা তো এগুলো লুকাতে পারছি না। আমরাই তাদেরকে আমাদের নাড়ি থেকে ছিন্ন করছি।’
নতুন প্রজন্মের স্বদেশ বিমুখতার কারণ হিসেবে অনেকে অনেক কিছু বললেও এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ নিয়ে সবাই একমত। তাদের মতে, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার, নতুন প্রজন্মের মা-বাবা ও প্রবাসী সামাজিক সংগঠনগুলোর বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রথমেই সরকারকে দেশের নেতিবাচক দিকগুলো দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যদিকে মা-বাবা ও সামাজিক সংগঠনগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে দেশের গৌরবগাথা তুলে ধরলে অন্তত বর্তমান প্রজন্মকে কিছুটা হলেও দেশের প্রতি আকৃষ্ট করা যাবে। একটা প্রজন্মকে স্বদেশের প্রতি আকৃষ্ট করা গেলে তাদের পরবর্তী প্রজন্মেও সে ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।