নাকেশার মৃত্যু ও নগরের সীমাবদ্ধ বোধিচিত্ত

শেষ দিনগুলোয় ম্যানহাটনের ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের এই বেঞ্চেই নাকেশা প্রায় সময় বসে থাকতেন। সর্বশেষ এই বেঞ্চেই নাকেশার নিথর দেহ পড়ে ছিল। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস
শেষ দিনগুলোয় ম্যানহাটনের ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের এই বেঞ্চেই নাকেশা প্রায় সময় বসে থাকতেন। সর্বশেষ এই বেঞ্চেই নাকেশার নিথর দেহ পড়ে ছিল। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

নাকেশা উইলিয়ামস। ম্যানহাটনের রেস্তোরাঁ পাড়া ফোরটি সিক্সথ স্ট্রিট বা কখনো পার্ক অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে। ফুটপাতে পথচারীরা নিত্যদিনের যাওয়া-আসার মাঝে ঠায় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে দেখতেন চল্লিশোর্ধ্ব এই নারীকে। আফ্রিকান-আমেরিকান ও গৃহহীন। ফুটপাতের ধারে ঠিক যেন এক স্থির বৃক্ষ হয়েছিলেন তিনি। তবে মাঝে মাঝে এলোমেলো পায়চারি করতেন। কখনো-সখনো একটু আধটু নিজের মনেই বিড়বিড়ও করতেন। বেশির ভাগ লোকই অবশ্য তাঁর নাম-ধাম জানতেন না। বেশভূষায় ভীষণ অগোছালো। তবুও নিত্যদিনের দেখায় পথচারীদের একরকম আত্মীয়ই যেন বনে যান নারীটি। প্রথম দেখায় যে কারুর কাছে এই গৃহহীণ নারীটি কিন্তু কম কৌতূহল জাগাননি। সে তাঁর যাপিত জীবনের কারণেই। এদিকে ফুটপাতও ভীষণ আত্মীয় করে নিয়েছিল এই নিঃসঙ্গ নারীটিকে।
কিন্তু একদিন এই ফুটপাত, এই পথচারী কিংবা কখনো নির্জন বিষাদগ্রস্ত না হওয়া এই ম্যানহাটন শহরতলি- নারীটিকে আর নড়তে দেখল না, পায়চারিও নয়, বিড়বিড়ও নয়। একেবারে অবিচল এবং শ্বাস-প্রশ্বাসহীন। শেষ বসে ছিলেন ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের একটি বেঞ্চে। শহরের মানুষগুলোর থেকে যেন অভিমানে পাড়ি জমালেন অন্য কোনো ভুবন-গাঁয়। যেখানে সকলের হয়তো একটি ঘর থাকে। হেঁশেল থাকে। সংসারও কি থাকে? হবে হয়তো! ম্যানহাটনের উঁচু উঁচু হাইরাইজগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে দেখল নারীটির দূরদেশে পাড়ি জমানো। যাওয়ার আগে একটি বিল্ডিংও তাঁকে বলতে পারল না, ‘এই যে মিস উইলিয়ামস, ঘর ছেড়ে কোথায় চলেছেন?’ একটি অ্যাপার্টমেন্টও বলতে পারল না, ‘রাত অনেক হলো, এবার শুয়ে পড়ুন। নাকি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করছে? সঙ্গে পুরোনো কারুর কথাও কি মনে পড়ছে?’ কিন্তু তা আর হলো কই! ইট-পাথরের হৃদয়ে গড়া নিউইয়র্ক নগরীতে নেই ঠিকানা নাকেশা উইলিয়ামসের পথই ছিল ঠিকানা, পথেই সাঙ্গ হলো ভবলীলা।

নিউইয়র্কের ফুটপাতে গৃহহীন জীবন যাপন করা নাকেশা উইলিয়ামস এখন শুধুই ছবি। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস
নিউইয়র্কের ফুটপাতে গৃহহীন জীবন যাপন করা নাকেশা উইলিয়ামস এখন শুধুই ছবি। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

গৃহহীন নাকেশা উইলিয়ামস (৪৬) মারা যান ২০১৬ সালে। তাঁর মৃত্যু নিয়ে তখন তেমন কোনো আলোচনা হয়নি শহরে। অন্য আর দশটা গৃহহীন লোকও মারা গেলে হয়তো তেমনটাই হয় এই শহরে। হয়তো সব শহরেই। তবে তাঁর মৃত্যু নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে গোটা আমেরিকায়। এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপানো তাঁর মৃত্যু সংবাদ। শুধু তাই নয়, ৪ মার্চ বিশ্বখ্যাত এই পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হয় অশ্রুতপূর্ব এই নারীটির মৃত্যু সংবাদ। এরপর আরও অনেকগুলো খবর প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমসসহ অন্যান্য অনেক সংবাদপত্র ও অনলাইন। মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দিচ্ছে মূলত নাকেশা উইলিয়ামসের পুরো জীবনের গল্পটি। নিউইয়র্ক নগর কর্তৃপক্ষও এখন নড়েচড়ে বসছে গৃহহীন লোকদের প্রতি রাজ্যের তথা পুরো রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্মূল্যায়নের অভিপ্রায়ে।
মিস উইলিয়ামসকে বহু মানুষ, বিভিন্ন সংস্থা সাহায্য করতে চেয়েছে। কিন্তু দৃঢ় সংকল্পে সেসব প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি বারবার। প্রত্যক্ষদর্শীরা ভেবে হয়রান হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে দেখে একটু এলোমেলো মনে হলেও নারীটির দৃঢ়চেতা মনোবল আর তাঁর আলুথালু পথের জীবনকে কোনোভাবেই মেলানো যাচ্ছে না। যাঁরা তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন, সবার মনেই সহানুভূতি তৈরি হয়েছে। যদিও সহানুভূতি না বলে একে সমীহ বললেও খুব বেশি ভুল হবে না।
চিকিৎসকেরা এখন বলছেন, নাকেশা সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। তাঁর যাপিত জীবনও অবশ্য সে রকমটাই সাক্ষ্য দেয়। প্রথম দেখায় তাকে পাগল বলেও ভুল হয়েছে অনেকের। সবাই অবাক হয়ে দেখেছেন, নাকেশা হাল আমল থেকে ধ্রুপদি আমলের সাহিত্য পড়ছেন বসে। তাও আবার ওই ফুটপাতেই। দিন নেই, রাত নেই। বছরের পর বছর নাকেশা পথেই বাস করেছেন। অথচ এই নাকেশাই কিনা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তুখোড় ছাত্রী! বন্ধুদের কাছে রীতিমতো ‘হিরো’। কি পড়াশোনা, কি নাচ, গান কিংবা আবৃত্তি- নাকেশাকে তাঁর সময়ের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বলছেন তাঁর প্রাক্তন শিক্ষকেরা।

উইলিয়াম কলেজের শেষ দুই বছর নাচের সিনিয়র প্রজেক্টে ব্যস্ত সময় কেটেছে নাকেশার। ১৯৯২ সালে নাচের একটি কর্মশালায়। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস
উইলিয়াম কলেজের শেষ দুই বছর নাচের সিনিয়র প্রজেক্টে ব্যস্ত সময় কেটেছে নাকেশার। ১৯৯২ সালে নাচের একটি কর্মশালায়। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস


নাকেশার মাস্কেটিয়ার জীবন
নাকেশা স্কুল শুরু করেছিলেন নিউজার্সিতে। নিউজার্সির ক্যামডেনে উড্রো উইলসন হাইস্কুল শেষ করে ম্যাসাচুসেটসের ঐতিহ্যবাহী উইলিয়াম কলেজ। মাঝে কিছুদিন পড়াশোনায় বিরতি দিয়ে রুটজার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামডেন ক্যাম্পাসে ভর্তি, তারপর আবার উইলিয়াম কলেজে প্রত্যাবর্তন। সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই রীতিমতো প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে ভালো ফলাফলের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন তিনি।
হাইস্কুলে পড়ার সময় নাকেশা বরাবরই তাঁর ক্লাসে প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ন্যাশনাল অনার সোসাইটির সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্কুলের গানের দলে যোগ দিলে তাঁর সংগীত প্রতিভাও সকলের সামনে আসে। অন্যদিকে, স্কুলের নিউজলেটার ও বার্ষিক প্রকাশনায় নাকেশার ছিল নেতৃস্থানীয় আসন।
উড্রো উইলসন হাইস্কুলে বর্ষসেরা ছাত্র নির্বাচনে নাকেশা যৌথভাবে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। ১৯৮৮ সালে হাইস্কুলের শেষ পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অর্জন করে ভর্তি হন উইলিয়াম কলেজে। হাইস্কুলে ভালো ফলের কারণে কলেজ ও স্থানীয় চার্চ থেকে পাওয়া বৃত্তিতে পড়ালেখার খরচ নিয়ে নাকেশাকে কখনো চিন্তা করতে হয়নি।

অ্যাঞ্জেলিক ফিস্টার, ভালদা ক্রিস্টিয়ান, রবিন কার্টার ও নাকেশা উইলিয়ামস— উইলিয়াম কলেজের ‘ফোর মাস্কেটিয়ার্স’। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস
অ্যাঞ্জেলিক ফিস্টার, ভালদা ক্রিস্টিয়ান, রবিন কার্টার ও নাকেশা উইলিয়ামস— উইলিয়াম কলেজের ‘ফোর মাস্কেটিয়ার্স’। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

উইলিয়াম কলেজে নাকেশা গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন এক অনন্য উচ্চতা নিয়ে। নাকেশার গবেষণাপত্র আফ্রিকান স্টাডিজে শ্রেষ্ঠ গবেষণার পুরস্কার পায়। উইলিয়াম কলেজের দুই শতাধিক বছরের ইতিহাসে কোনো আফ্রিকান-আমেরিকানের জন্য এটাই প্রথম শ্রেষ্ঠ গবেষকের স্বীকৃতি।
উইলিয়াম কলেজের জীবন নাকেশার জন্য ছিল স্বর্ণালি সময়। ভালো ফলাফলের পাশাপাশি পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকেশা ছিলেন একনামে পরিচিত। সেখানে নাকেশার খুব কাছের একজন বন্ধু ছিলেন ভালদা ক্লার্ক ক্রিস্টিয়ান। এখন মেরিল্যান্ডে একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্রিস্টিয়ান। নাকেশার সঙ্গে কলেজের প্রথম দিককার কথা নিউইয়র্ক টাইমসের কাছে স্মৃতিচারণায় বললেন, ‘নাকেশার বাড়ি থেকে বার্কশায়ার কাউন্টির কলেজ ছিল অনেক দূর। এত দূরে পড়তে এসে বিভিন্ন অঞ্চলের নতুন সহপাঠীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে নাকেশার সময় লাগেনি। ওকে মাঝখানে অনেক খুঁজেছি। কোথাও পাইনি। কলেজে ও ছিল আমার সব থেকে কাছের বন্ধু।’
তানিয়া নিকোলসন মিলার নামের আরেক সহপাঠী নিউইয়র্ক টাইমসকে বললেন, ‘নাকেশা, ভালদা ক্রিস্টিয়ান, অ্যাঞ্জেলিক ফিস্টার ও রবিন কার্টার— এই চারজন মেয়েকে সব সময় এক সঙ্গে দেখা যেত বলে পুরো কলেজে আমরা সবাই তাদের ডাকতাম ‘ফোর মাস্কেটিয়ার্স’। আলেক্সান্ডার দুমা’র উপন্যাসের নায়কের মতোই ছিল ওরা, যাদের কলেজের সব মেয়ে সব সময় অনুসরণ করতে চেয়েছে। মেয়ে হিসেবে ওদের আত্মমর্যাদা বোধ ছিল ধারণারও অতীত।’
উইলিয়াম কলেজে নাকেশাকে কাছ থেকে বেড়ে উঠতে দেখেছিলেন স্যান্ড্রা বার্টন। স্যান্ড্রা ছিলেন নাকেশার নাচের শিক্ষক ও কলেজের নৃত্য বিভাগের পরিচালক। এক অনুষ্ঠানে নাকেশার প্রতিভা দেখে স্যান্ড্রাই নাকেশাকে নাচের দলে ভর্তি করান। পুরো কলেজ জীবনে স্যান্ড্রাই নাকেশার ‘মেন্টর’ হয়ে উঠেছিলেন। কলেজ শেষ করেও নাকেশার সঙ্গে স্যান্ড্রার ফোন বা ই-মেইলে যোগাযোগ ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু একদিন সেই যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় বলে স্যান্ড্রা স্মৃতিচারণায় জানালেন।

১৯৯৩ সালে উইলিয়াম কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার দিন সহপাঠী জোয়ান রকলিনের সঙ্গে। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস
১৯৯৩ সালে উইলিয়াম কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার দিন সহপাঠী জোয়ান রকলিনের সঙ্গে। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস


গৃহহীন হওয়ার গল্প
গ্র্যাজুয়েশন শেষে নাকেশা সিউয়িকলি অ্যাকাডেমি নামে একটি প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন। সেই সময় এই স্কুলে ফি বছর ৭০০ শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হতো। বেশ বড় আর নামকরা স্কুল। নাকেশার প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে সৃষ্টিশীল শিক্ষক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু নাকেশার মস্তিষ্কে হঠাৎ একদিন বিভ্রাট দেখা দিতে শুরু করে। সে সময় নাকেশাকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের কয়েকজন স্মৃতিচারণা করলেন— নাকেশা দাবি করতে শুরু করেন, সিআইএর লোক তাঁকে সব সময় অনুসরণ করছে। এরপরও একভাবে শিক্ষকতাতেই নাকেশার কেটে যাচ্ছিল সময়। কিন্তু সমস্যা বাড়তে শুরু করল যখন সব বন্ধু-বান্ধবকেই একময় সন্দেহ করতে শুরু করলেন তিনি। সকলের সংসর্গও এড়িয়ে চলতে শুরু করেন সে সময় থেকেই। কাছের অনেককে বিভিন্ন উদ্বেগের কথা জানিয়ে নিয়মিত ই-মেইল করতেন এক সময়। সকলে অবশ্য প্রথম প্রথম অবাক হতো তাঁর অদ্ভুত সব ই–মেইল পেয়ে।
এর পর, এক সময় সকলের সঙ্গেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেন নাকেশা। তাঁর পরিচিতরাও হারিয়ে ফেলেন তাঁকে। বেশ ক’বছর বাদে ম্যানহাটনের রাস্তায় গৃহহীন নাকেশাকে কিছুটা উদ্‌ভ্রান্ত রূপে আবিষ্কার করে অনেক পুরোনো বন্ধু ভিরমি খেয়েছিলেন। বন্ধু হিসেবে অনেকের তাঁর প্রতি সম্মান ছিল, সহানুভূতিও ছিল। কিন্তু সাহায্য করার কথা বললেই নাকেশা তাঁদের তাড়িয়ে দিয়েছেন, নয়তো নিজেই আর মুখ ঘুরিয়ে তাঁদের সঙ্গে কখনো কথা বলেননি। ফুটপাতে নাকেশা বই পড়তেন, চিঠি লিখতেন, ডায়েরিও লিখেছেন।

নাকেশার আগের কয়েকজন বন্ধু ও ফুটপাতের জীবনের সুহৃদ ফোরটি সিক্সথ স্ট্রিটে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে জড়ো হয়েছেন। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস
নাকেশার আগের কয়েকজন বন্ধু ও ফুটপাতের জীবনের সুহৃদ ফোরটি সিক্সথ স্ট্রিটে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে জড়ো হয়েছেন। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

স্যান্ড্রা বার্টনকে শেষবার ২০১০ সালে নাকেশা একটি ই-মেইল লিখেছিলেন। তখন নাকেশার সঙ্গে পরিচয়ের দুই দশক পার হয়ে গিয়েছে। ওই ই-মেইলে নাকেশা খোদ তাঁর পুরোনো মেন্টরের বিরুদ্ধে একগাদা বিষোদ্‌গার করেছিলেন।
তখন নাকেশার পুরোপুরি পথেই জীবন। জেপি মরগ্যান চেজের কর্মকর্তা পামেলা জে. ডিয়ারডেন। কয়েক বছর আগের কথা স্মরণ করলেন তিনি। এক বৃষ্টির সকালে অফিসে যাচ্ছিলেন। মধ্য ম্যানহাটনের হেলমসলি বিল্ডিংয়ের নিচে এক নারীকে দেখলেন বৃষ্টিতে জবুথবু হচ্ছেন। কিন্তু নির্বিকার। নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার তাগাদাও নেই চেহারার অভিব্যক্তিতে। লোহার শিকে নির্মিত ফুটপাতের ৩৬ বর্গফুটের একটি ‘গ্রেট’। রাতে-দিনে নাকেশা তখন থাকতেন সেইখানেই। ওখানেই দাঁড়িয়ে ভিজছিলেন। নাকেশার দিকে ছাতা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ডিয়ারডেন। নাকেশাও ডিয়ারডেনকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি। ম্যানহাটনে মিস ডিয়ারডেনকে পিজে নামে সবাই একনামে চেনে। পিজের সঙ্গে বন্ধুত্বের সেই শুরু। নাকেশার শেষ দিনগুলোতে এই পিজেই তাঁর নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতেন।
পিজে জানালেন, অফিস আসা-যাওয়ার পথে প্রায়ই কথাবার্তা হতো নাকেশার সঙ্গে। নাকেশা এমনিতে শপিং ব্যাগ, বইপত্র, খাবারের কনটেইনার, ধাতব ইউটিলিটি কার্ট ঘেরা ওই গ্রেটের ওপর বসে থাকতেন। নাকেশার চরিত্রের দৃঢ়তা দেখেই পিজে তাঁর অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। পিজে নাকেশার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতেন। সে গল্প হয়তো শুরু হলো এক জায়গায়, হিল্লি-দিল্লি করে গিয়ে ঠেকত শেষে আর এক জায়গায়।

স্যান্ড্রা বার্টন, উইলিয়াম কলেজের নৃত্য বিভাগের বর্তমান চেয়ারওম্যান, নাকেশার কলেজজীবনের ‘মেন্টর’। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস
স্যান্ড্রা বার্টন, উইলিয়াম কলেজের নৃত্য বিভাগের বর্তমান চেয়ারওম্যান, নাকেশার কলেজজীবনের ‘মেন্টর’। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

নাকেশা পিজেকে জানিয়েছিলেন, নভেল দারুণ লাগে তাঁর। নাকেশা তাঁর সদ্য পড়া নভেলগুলো নিয়ে গল্প করতেন। জেন অস্টেন থেকে জোডি পিকো কেউ বাদ ছিল না নাকেশার পড়ার লিস্টে। নাকেশার সঙ্গে কথা বলার সময় কত বাজল ঘড়িতে— সে কথা ভুলেই যেতেন পিজে। কিন্তু গল্পে ছেদ পড়ত নাকেশার কারণেই। প্রায়ই তাঁর কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে পড়ত।
এর মাঝে গৃহহীন অবস্থাতেই নাকেশা দুবার গর্ভবতী হয়ে পড়েন। প্রথম বাচ্চাটি জন্মেছিল অটিস্টিক হয়ে। নাকেশার এলোমেলো পথের জীবন বলে বাচ্চাটির দায়িত্ব নেয় ফস্টার কেয়ার। আর, দ্বিতীয় বাচ্চাটিকে তার বায়োলজিক্যাল বাবা নিতে রাজি হন। কিন্তু বাচ্চাদের নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন নাকেশা। তা না পেরে সিজোফ্রেনিক তীব্রতা বাড়তে থাকে।
নাকেশার ডায়েরিতে দেখা যায়, তিনি লিখেছেন- তাঁর ব্যাগ ও সম্পত্তি এফবিআই চুরি করেছে। তার বাচ্চাকেও চুরি করেছে এফবিআই-ই। পুরোটাই যে ভ্রম, বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারও। কিন্তু অবাক করার বিষয়, এই মানসিক বিভ্রমেও আত্মমর্যাদাবোধ কখনোই ভুলে যেতেন না নাকেশা। হয়তো ‘মাস্কেটিয়ার’ ছিলেন বলেই একদা জ্বলজ্বলে এই নক্ষত্রের পক্ষে সেটি ভোলা সম্ভব ছিল না।

নাকেশার মতো গৃহহীনদের জন্য কী করছে নিউইয়র্ক?
নিউইয়র্ক নগরের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও গৃহহীন সমস্যা সমাধানে নানা ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। শহরে গৃহহীন লোকের সংখ্যা এই মুহূর্তে প্রায় ৩ হাজার ৯০০ বলে জানা গেছে। নগর কর্তৃপক্ষের মতে, গৃহহীন সমস্যা সমাধান সহজ নয়। গৃহহীনদের জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক উন্নয়ন, উচ্ছেদের উদ্বেগ কমাতে আইনি হয়রানির অবসান- এ সবকিছুর সমন্বয় করতে বেশ হিমশিম খাওয়ার অবস্থা প্রশাসনের।

ফোরটি সিক্সথ স্ট্রিট ও পার্ক অ্যাভিনিউয়ের ‘গ্রেটে’ই বসবাস করতেন নাকেশা। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস
ফোরটি সিক্সথ স্ট্রিট ও পার্ক অ্যাভিনিউয়ের ‘গ্রেটে’ই বসবাস করতেন নাকেশা। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

নিউইয়র্ক টাইমস গৃহহীন নাকেশা উইলিয়ামসের জীবনাবসান নিয়ে খবর প্রকাশ করলে অনেকের হৃদয় ভারী হয়ে ওঠে। অনেকের প্রশ্ন: নাকেশা উইলিয়ামস কি আমাদের অবহেলাতে মৃত্যুবরণ করলেন? আমরা কি চেষ্টা করলে তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারতাম না? নাকেশা নিজে সহায়তা ফিরিয়ে দিয়েছে বলে কি আমরা জোর করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারতাম না?
নিউইয়র্কের গৃহহীনদের আশ্রয় ও জীবিকা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ‘পাথওয়েজে’র প্রতিষ্ঠাতা স্যাম সেম্বারিস এর উত্তর দেন। গৃহহীনদের নিয়ে কাজ করা ‘প্রজেক্ট হেল্প’র সঙ্গেও একদা যুক্ত এই অভিজ্ঞ কর্মকর্তা বললেন, ‘মানসিকভাবে অসুস্থদের অধিকার এবং তাদের কারও দ্বারা জনগণের নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয় এই দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় ‘ইনভলান্টারি কমিটমেন্ট’ শীর্ষক একটি আইন রয়েছে। সাধারণত এই ব্যবস্থা বদ্ধ উন্মাদ লোকদের জন্য প্রযোজ্য, যাদের নিজের বা অন্যদের জন্য বিপজ্জনক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে নাকেশা এই ধরনের রোগী ছিলেন না। এই ধরনের রোগীকে নিউইয়র্কে মূলধারার সমাজে অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য আইন আছে। এ ছাড়া, যেসব রোগীর মনোচিকিৎসকের প্রয়োজন, তাঁরা চিকিৎসা নিতে অস্বীকৃতি জানালে, তাদের পক্ষে তাদের পরিবারের কেউ বা তাঁর চিকিৎসক মানসিক স্বাস্থ্য আদালতে আবেদন করতে পারেন। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে, মনোচিকিৎসকের কাছে নেওয়ার পরও রোগীর উন্নতি ঘটেনি। আমরা নাকেশার মতো কোনো রোগীকে হয়তো বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি করেছি। ৩০ দিন পর হাসপাতাল তাঁকে রিলিজ দিয়েছে। তারপর রোগী আবার হয়তো সেই ফুটপাতেই ফিরে গেছে। কারণ, রাজ্যের প্রকল্পগুলো রোগীর সার্বিক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে প্রণয়ন করা হয়নি। প্রকল্পের দায়িত্ব রোগীকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসা খরচ জোগানো পর্যন্তই। এভাবে গৃহহীন সমস্যা সমাধান করা অসম্ভব।’

পার্ক অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাতে দোকানদার হামিদ এলহিরি নাকেশার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, নাকেশা অন্য কোথাও গেলে তাঁর জিনিসপত্র পাহারা দিতেন এলহিরি। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস
পার্ক অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাতে দোকানদার হামিদ এলহিরি নাকেশার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, নাকেশা অন্য কোথাও গেলে তাঁর জিনিসপত্র পাহারা দিতেন এলহিরি। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

নিউইয়র্ক নগর কর্তৃপক্ষকে প্রযোজ্য ক্ষেত্র বিবেচনায় গৃহহীন লোকদের জন্য সাময়িক আশ্রয় জোগাতে আদেশ দিয়েছেন আদালত। কর্তৃপক্ষ গৃহহীনদের জন্য ‘আশ্রয় প্রকল্পে’ বার্ষিক ১৮০ কোটি ডলার বাজেট বরাদ্দ করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র, অ্যাপার্টমেন্ট, হোটেলের কক্ষ বরাদ্দ করা হচ্ছে। এই ধরনের প্রকল্প গৃহহীনদের জন্য অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। তবে এই প্রকল্পের ব্যয়ভারও কম নয়। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পাওয়াও সহজ নয়। আবেদনের পর
বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আশ্রয় পেতে এক বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে।
নিউইয়র্ক শহর কর্তৃপক্ষ শুরুতে ইস্ট ওয়ান ফিফটি ওয়ান স্ট্রিটে একটি ভবনে এই আশ্রয় প্রকল্প শুরু করে। নগর কর্তৃপক্ষের বরাদ্দকৃত এই আশ্রয় ভবন প্রিভেনশন অ্যাসিসটেন্স অ্যান্ড টেম্পোরারি হাউজিং বা সংক্ষেপে ‘পাথ’ নামে পরিচিত। এতে আশ্রয় পেতে আনুষ্ঠানিক আবেদন করতে হয়। এর পর শক্ত এক ইন্টারভিউ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় আবেদনকারীদের। তারপর দশ দিনের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে সাময়িক থাকার সুযোগ দেয় কর্তৃপক্ষ। এই সময়ের মধ্যে নগর কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে দেখে, আবেদনকারী সত্যিই গৃহহীন কিনা। তারপর দীর্ঘ মেয়াদে আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হয়।
নিউইয়র্কের মেয়রের বার্ষিক ব্যবস্থাপনা প্রতিবেদনে দেখা যায়, পরিবারগুলো আশ্রয়কেন্দ্রে গড়ে ৪১৪ দিন করে থাকছে। এই আশ্রয়কেন্দ্র পর্ব সমাপ্তিও কম ঝক্কির কাজ নয়। বাড়ি ভাড়া ভাতার জন্য আবেদন কর, সাধ্যের মধ্যে অ্যাপার্টমেন্ট খোঁজো এবং তার সঙ্গে ভাগ্যকেও সহায় করতে হবে বৈ কি।
নিউইয়র্কে গৃহহীন লোকের স্রোত প্রথম নজরে আসে ২০১১ সালে। এই বছর রাজ্য সরকার নাগরিকদের বাড়ি ভাড়া ভাতা সুবিধা বাতিল করে। হাউজিং ও নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১২ সালের মধ্যে গৃহহীন লোকের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ শতাংশে, সংখ্যায় যা প্রায় ৫৭ হাজার। আমেরিকার মতো ধনী সমাজ ব্যবস্থায় এই ৫৭ হাজার গৃহহীন লোকের চাপ কম নয়। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৪ হাজারে।

নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল শাখায় নাকেশা কম্পিউটার ব্যবহার করতেন। এখান থেকেই তাঁর যত ই-মেইল লিখতেন। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস
নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল শাখায় নাকেশা কম্পিউটার ব্যবহার করতেন। এখান থেকেই তাঁর যত ই-মেইল লিখতেন। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

২০১৪ সালে ডি ব্লাজিও মেয়র হওয়ার পরও গৃহহীনের সংখ্যাবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। এখন ৭৭ হাজার লোক নিউইয়র্কের পথে-ঘাটে গৃহহীন জীবন কাটাচ্ছে। ‘পাথ’ প্রকল্প বা সীমিত পরিসরে পুনরায় বাড়ি ভাড়া ভাতা চালু না করলে এই সংখ্যা আরও বাড়ত বলে মনে করা হয়। এখন প্রতিদিন এক শ করে পরিবার পাথের আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিচ্ছে।
হোমলেস সার্ভিস অধিদপ্তর আশ্রয় ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করছে। পাঁচ বছরের জন্য ৯০টি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নতুন কার্যক্রম অচিরেই শুরু করা হবে বলে জানা গেছে। নতুন কার্যক্রমে অস্থায়ী হোটেল কক্ষ, ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্ট সাময়িক বরাদ্দের চিন্তা বাদ দেওয়া হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবারগুলোকে ভোগান্তি ছাড়াই কীভাবে স্থানান্তর করা যায়, সেই পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত থেরাপিস্ট মার্শা লিনেহানের একটি উক্তি আছে। মিস উইলিয়ামসের মতো কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইলে প্রধান শর্ত, তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর অবস্থানটি দেখা এবং সেটি গ্রহণ করার জন্য উন্মুক্ত মন তৈরি করা।
সেম্বারিস প্রশ্ন তোলেন, ‘এমন একটি আশ্রয় প্রকল্প নেওয়া যেত কিনা, যেটি আরও সম্মানজনক। গৃহহীনদের জোর করে মানসিক চিকিৎসা না দিয়ে, নিজের মতো থাকতে দেওয়া এবং তাঁর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কাজ করা হলে সেটি আরও কার্যকর হতে পারত।’
সেম্বারিস বলেন, ‘ইনভলান্টারি কমিটমেন্ট যে পুরোপুরি ভুল পদক্ষেপ, তা বলছি না। আমি আরও বাস্তববাদী হতে বলছি। যদি মানসিক চিকিৎসা দেওয়াই সত্যিকারের সমাধান হয়, আর তা যদি প্রয়োজনীয়ই হয়, তেমন ক্ষেত্রে রোগীকে বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি করাই শ্রেয়। কিন্তু আমি এও মনে রাখতে বলছি, সবার ক্ষেত্রে মানসিক ঘটনাগুলো একই রকম উন্মাদ স্তরের নাও হতে পারে। অনেকের সংবেদনশীল সত্তাকে আপনি অগ্রাহ্য করতে পারেন না। কারণ সবার জীবনেরই বেড়ে ওঠার গল্পগুলো আলাদা।’

জেনোভিভ স্টোয়েল, নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল শাখার ব্যবস্থাপক। তিনি জানালেন, নাকেশা এখানেই বই পড়তেন। কখনোই কোনো ঝামেলা করেননি। শুধু একবার লাইব্রেরির কিছু সভ্য নাকেশার অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষকে। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস
জেনোভিভ স্টোয়েল, নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল শাখার ব্যবস্থাপক। তিনি জানালেন, নাকেশা এখানেই বই পড়তেন। কখনোই কোনো ঝামেলা করেননি। শুধু একবার লাইব্রেরির কিছু সভ্য নাকেশার অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষকে। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

গৃহহীন সমস্যার আরেকটি দিক হলো গণগ্রেপ্তার ও জেলে প্রেরণ। সেম্বারিস এই বিষয়ে বলেন, যেসব লোককে জেলে পাঠানো হয়েছে, তাদের অধিকাংশকেই মানসিকভাবে উন্মাদ বিবেচনা করা হয়েছে। কোনো ধরনের উপার্জনের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ হলে এবং এর কারণে তাকে বাড়ি ছাড়াও হতে হলে একমাত্র উপায় থাকে অন্যের সহায়তা। না হলে তাকে গৃহহীন জীবনযাপনে বাধ্য হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের নাগরিকদের কেন গৃহহীন অবস্থায় পড়তে হবে? এই নারীটি, উইলিয়ামস কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে গ্র্যাজুয়েশন সমাপ্ত করেছে। তার কিনা জীবনটা কাটল রাস্তায়? এই অবস্থায় আসার আগেই রাষ্ট্র বা আমরা তাঁর জন্য কিছু করতে পারলাম না কেন? মানসিক চিকিৎসার পরিসর বৃদ্ধি গৃহহীন লোকের জন্য একটা থাকার জায়গা নিশ্চিত করে না। প্রথম থেকেই এ ধরনের লোক কি চিন্তা করছেন সেটি মন দিয়ে শুনতে হবে। তাঁদের সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলে চলবে না। তাঁর নিজস্ব মতামতকে শ্রদ্ধা জানাতে পারলেই তাঁকে অনেকটা উদ্বেগহীন জীবন দেওয়া যাবে।

শেষ কথা
পাগলামো সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণা নিয়ে বিশ্বখ্যাত ফরাসি চিন্তাবিদ মিশেল ফুকো সত্তরের দশকে লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘ফোলি এ দেরেজোঁ’। বইটির ইংরেজি তর্জমা ‘ম্যাডনেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’। ফরাসি দেরেজোঁ শব্দটি ইংরেজিতে ডিরিজন হয়ে শেষে হয়েছে আনরিজন। মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের ধারণাকৃত যুক্তি ব্যবস্থার বাইরে কোনো আচরণ। ফুকো তাঁর বইটিতে পাগলামির ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে পাগলা গারদের উৎপত্তি ও প্রবর্তনের কারণ অনুসন্ধান করেছেন। পুরো ব্যাপারটিকে তিনি ক্ষমতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। সাদা চোখে যাকে আমরা পাগলামি বলে সাব্যস্ত করি তারও পেছনে একসময় ক্ষমতার উৎসাহ কাজ করেছে, এ সময়ও করছে। একই রকমভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রবর্তনের সঙ্গে হাসপাতালের প্রবর্তনেও রোগীর উপকার করা নয়, ক্ষমতার উৎসাহই মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল। এই নিয়ে ফুকোর আরেকটি বিখ্যাত বই ‘বার্থ অব ক্লিনিক’। জেল ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও ফুকোর সমালোচনা এই গোত্রেরই। এটি ধান ভানতে শিবের গীত নয়। গৃহহীন ও ভিন্ন মানসিকতার মানুষদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি শোধনমুখী না হলে এই সব মানুষ প্রান্তিক হতে হতে অস্তিত্ব-শূন্য হয়ে পড়বে- এটিই বিদ্যমান ব্যবস্থার ভবিতব্য। সে কথাই যেন স্যাম সেম্বারিস পুনর্ব্যক্ত করলেন।
বৌদ্ধ দর্শনে সর্বকল্যাণকামী এক হৃদয়ের কথা বলা হয়েছে। অতীশ দীপঙ্কর এর প্রচার করেছিলেন ‘বোধিচিত্ত’ নামে। ক্ষমতাকামী রাষ্ট্রের হৃদয়ে ভালোবাসা ‘সীমাবদ্ধ’। রাষ্ট্রের বোধিচিত্ত সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লে নাকেশা উইলিয়ামসের মতো গৃহহীনেরা রাষ্ট্রের কোথাও ঠাঁই না পেয়ে আশ্রয় নেন পথে-ফুটপাতে। রাষ্ট্র তাঁকে হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র বা পাগলা গারদে রাখাই নিরাপদ মনে করে। নয়তো পুরে ফেলে জেলখানায়। কিন্তু সর্বকল্যাণকামী রাষ্ট্রনীতি হয়তো ভিন্ন চিন্তার, ভিন্ন অনুভূতির মানুষগুলোকে তার কল্যাণের অনুগামী করতে কৃপণ হয় না।