প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের ফেরিওয়ালা

প্রবাসেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজ–সংস্কৃতিকে লালন ও তা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে নিরলস কাজ করছেন ইমরান আহমেদ চৌধুরী
প্রবাসেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজ–সংস্কৃতিকে লালন ও তা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে নিরলস কাজ করছেন ইমরান আহমেদ চৌধুরী

স্বদেশ ছেড়ে দূর দেশে গেলেও কেউ নিজের দেশ আর মাটিকে ভুলতে পারেন না। সরব আর নীরব কাজের মধ্য দিয়ে তাঁরা নিজেদের এই যন্ত্রণার কথা জানান দেন। এঁদেরই একজন ইমরান আহমেদ চৌধুরী। বসবাস করেন যুক্তরাজ্যের ইস্ট মিডল্যান্ডের অন্যতম শহর নর্থ হ্যাম্পটনে। রেস্তোরাঁ ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠিত তিনি। এর বাইরে একজন নিবেদিত সংগঠক হিসেবে যুক্তরাজ্যজুড়ে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে প্রবাসের বহুজাতিক সমাজে আমাদের নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে নেওয়ার কাজটি তিনি করছেন নিষ্ঠা ও বিনয়ের সঙ্গে।
প্রচার বিমুখ ইমরান চৌধুরী মাত্র ১১ বছর বয়সে বাংলাদেশর মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর বাবা পাকিস্তান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কাজ করতেন। যুদ্ধ শুরু হলে বাবা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পরিবারের সঙ্গে কিশোর ইমরান চলে যান ভারতের শরণার্থীশিবিরে।
মুক্তিযোদ্ধা বাবার সন্তান ইমরান মাত্র ১১ বছর বয়সে শরণার্থীশিবিরে পত্রিকা বিতরণ করতেন। আগরতলার জি পি হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবা দিয়েছেন। বাবার সঙ্গে বড় ভাই বাবুল যুদ্ধে যোগ দিলেন। পরিবার নিয়ে শরণার্থীশিবিরের জীবনের স্মৃতি বয়ে বেড়ান আজও। মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কাছে শুধু এক দেশ প্রাপ্তির ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, তারচেয়ে বেশি কিছু।
ইমরান চৌধুরী বড় ভাই বাবুল চৌধুরীকে যুদ্ধে হারিয়েছেন। পাক হানাদারদের হাতে ধরা পড়েন মাত্র ১৭ বছরের যোদ্ধা বাবুল। একাত্তরের ২১ নভেম্বর তাঁকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। শহীদ বাবুল চৌধুরীর অনুজ ইমরান স্বাধীন দেশে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। একপর্যায়ে যুক্তরাজ্য চলে আসেন। জড়িয়ে পোড়েন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়। দেশ ছাড়লেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশের সমাজ সংস্কৃতিকে ভুলতে পারেন না। যুক্তরাজ্যের নানা শহরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আমাদের বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। প্রবাসে আমাদের প্রজন্মের কাছে শেকড়ের পরিচয় তুলে ধরার নিরলস কাজ করছেন তিনি। হাউস অব কমনসের সেমিনার থেকে শুরু করে প্রবাসে বাঙালিদের নিজস্ব যেকোনো অনুষ্ঠানে সক্রিয় ইমরান চৌধুরী। নিয়মিত লেখেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে।
টিভি টক শো ছাড়াও নানা পত্রিকা, জার্নালে ইমরান লেখেন সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে। যুক্তরাজ্যের মূলধারায় আমাদের প্রজন্ম আত্মপরিচয় নিয়ে কীভাবে আরও শক্ত অবস্থানে যেতে পারেন সেই প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন ইমরান চৌধুরী। স্থানীয় দাতব্য ইভেন্ট থেকে শুরু করে ক্রীড়া, সংস্কৃতিতে তিনি সক্রিয়। বিভিন্ন চ্যারিটি ইভেন্টের জন্য তহবিল সংগ্রহে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। রেসিং কার স্পনসর করেন। ব্যবসার মাধ্যমে চ্যারিটিকে সহযোগিতা করার জন্য ২০১৩ সালে লন্ডন সিটির লর্ড মেয়র ইমরান আহমেদ চৌধুরীকে ‘ফ্রিডম অফ সিটি অফ লন্ডন’ সম্মাননা দেওয়া হয়। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের নানা সংস্থার কাছ থেকে সম্মাননা পেয়েছেন।
প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার এক প্রশ্নের জবাবে ইমরান আহমেদ চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ তাঁর জীবন গঠনে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শৈশবে দেখা মুক্তিযুদ্ধ, এর সঙ্গে নিজে জড়িয়ে যাওয়া, শরণার্থীশিবিরে থাকা, আর অগ্রজ হারানোর বেদনা তাঁকে তাড়িত করে। প্রবাসে তাই প্রতিদিন বুকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে লালন করে সক্রিয় থাকেন বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে যাওয়া ইমরান।