ট্রাম্প শান্তিতে নোবেল পাওয়ার যোগ্য?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রয়টার্স ফাইল ছবি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রয়টার্স ফাইল ছবি


মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মাথায় ২০০৯ সালে বারাক ওবামাকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়। ওবামার এই পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে তখন সমালোচনা কম হয়নি। সবাই বলাবলি করছিল, কিছু না করেই শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন তিনি। এমনও বলা হচ্ছিল, ওবামা ভবিষ্যতে যাতে শান্তির পক্ষে কাজ করেন, তাই হয়তো তাঁকে আগেভাগে নোবেল দেওয়া হয়েছে।

হোয়াইট হাউসে ওবামার উত্তরসূরি হিসেবে এখন আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি অত্যন্ত বিতর্কিত এক ব্যক্তি। তাঁর মানসিক সুস্থতা নিয়েও অনেকের প্রশ্ন আছে। এই সেদিনই তিনি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের হুমকির জবাবে বলেছিলেন, তাঁর পারমাণবিক বোমার বোতাম আরও বড়, আরও শক্তিশালী। তিনি রাশিয়াকে সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে আধুনিক, সুন্দর ও শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হতে বলেছিলেন। ট্রাম্পের ব্যক্তিজীবনও কলুষতায় ভরা। তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, মুসলিম বিদ্বেষ, বর্ণবাদের গুরুতর সব অভিযোগ রয়েছে।

ট্রাম্পের ক্ষমতার বয়স এক বছরের কিছু বেশি। এরই মধ্যে রব উঠেছে, ট্রাম্প শান্তিতে নোবেল পাওয়ার যোগ্য দাবিদার।

কত রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়! তো, ট্রাম্প শান্তির জন্য করেছেনটা কী?

সম্প্রতি দুই কোরিয়ার নেতাদের মধ্যে ঐতিহাসিক বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন যৌথ ঘোষণা দেন। তাঁরা দুই কোরিয়ার মধ্যকার ৬৮ বছরের যুদ্ধের ইতি টানার কথা বলেন। একই সঙ্গে কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করার ঘোষণা দেন।

রয়টার্সসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার নেতাকে এভাবে আলোচনার টেবিলে আনতে পারায় মুনকে অভিনন্দন জানান দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দায়ে জংয়ের স্ত্রী। অভিনন্দন বার্তায় তিনি বলেন, কৃতিত্বের জন্য মুনের শান্তিতে নোবেল পাওয়া উচিত। এই প্রশংসার জবাবে মুন তাঁর সরকারের জ্যেষ্ঠ সচিবদের বৈঠকে বলেছেন, তাঁর নয়, বরং ট্রাম্পেরই এই পুরস্কার পাওয়া উচিত।

মুনের মন্তব্যটি নিয়ে নানান ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। এমনও শোনা যায় যে তিনি নিছক বিনয় দেখাতে অমন কথা বলেছেন।

ব্যস, হয়ে গেল। মওকা পেয়ে গেল ট্রাম্প-সমর্থকেরা। এবার তারা গলা ফাটানো শুরু করেছে ‘নোবেল’, ‘নেবেল’ বলে।

ট্রাম্পের ‘অন্ধ’ সমর্থকদের কথা নাহয় বাদই দিলাম। কংগ্রেসের ১৮ জন রিপাবলিকান সদস্য পর্যন্ত নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পের নাম সদর্পে প্রস্তাব করেছেন। তাঁদের ভাষ্য, কোরীয় যুদ্ধের অবসান, উপদ্বীপে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ ও শান্তি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ‘অসামান্য’ অবদান রাখায় ট্রাম্পকে শান্তির নোবেল দেওয়া উচিত।

ট্রাম্প নিজের ঢোল নিজে পেটাতে ওস্তাদ। সেই ধারাবাহিকতায় তিনি অবশ্য এখন পর্যন্ত নিজের মুখে এই পুরস্কার চেয়ে বসেননি। তবে কোরীয় নেতাদের বৈঠকের কৃতিত্ব নিতে একটুও সময় নেননি।

শান্তির জন্য মুন ও কিমের বৈঠকটির গুরুত্ব নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু এই বৈঠকের প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পকে শান্তির নোবেল দেওয়ার দাবিটি হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে।

কোরীয় বৈঠক থেকে কিছু সুসংবাদ এসেছে বটে। আর তাতে আপাতত কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে। কিন্তু বিবেচনার বিষয় হলো, কোরীয় বৈঠকের ফল ‘ঘোষণা’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। সামনে ট্রাম্পের সঙ্গে কিমের বৈঠক হওয়ার কথা। সেই বৈঠকে কী হবে, তা অনুমান করা কঠিন।

কিমকে নমনীয় হতে, আলোচনার টেবিলে আসতে বাধ্য করতে ট্রাম্পের ভূমিকাকে বড় করে দেখছেন তাঁর সমর্থকেরা। তাঁরা বলছেন, গরম ট্রাম্পে নরম হয়েছেন কিম।

অনেকেই বলছেন, এখানে ট্রাম্পের কোনো অবদান নেই। কোরীয় উপদ্বীপে সত্যিকার শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের জন্য যদি কেউ শান্তির নোবেলের দাবিদার হন, তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন নিজেই। দুই কোরিয়ার সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে মুনের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই তিনি কাজে লেগে পড়েন। এ ক্ষেত্রে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটাতেও পিছপা হননি। কিমকে আলোচনায় রাজি করাতে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের অবদানও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।

কেউ কেউ বলছে, উত্তর কোরিয়ার ওপর কঠোর অবরোধ সম্ভবত কাজ দিয়েছে। তবে এই অবরোধ নতুন নয় যে ট্রাম্প পুরো কৃতিত্ব নেবেন।

কারও কারও মতে, কিম তাঁর আসল মিশন ‘ফুলফিল’ করেছেন। তাই এখন তিনি তাঁর দেশের অর্থনীতির দিকে মনোযোগ দিতে আলোচনায় রাজি হয়েছেন।

উত্তর কোরিয়া আজকের পর্যায়ে এক দিনে আসেনি। দেশটি হুট করে তার সব পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি একেবারেই বাদ দিয়ে দেবে, এমনটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম কখন, কী করে বসেন, তা বোঝা দায়। ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকেরাও স্বীকার করেন, কিমকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না।

অনেকেই মনে করেন, কিম সম্ভবত কখনোই তাঁর সব পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করবেন না। তবে তিনি এই প্রকল্প সীমিত করতে পারেন। তিনি এমন কিছু করতে পারেন, যাতে প্রতিবেশীরা ও যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে কম হুমকি মনে করেন।

ঘোষণা, প্রতিশ্রুতির মিষ্টি কথায় চিড়ে ভিজবে না। কোরীয় উপদ্বীপে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। তাই বলা যায়, শান্তির পথ বহু দূর। এমন অবস্থায় কোরীয় বৈঠকের আলোকে ট্রাম্পকে শান্তির নোবেল দেওয়ার দাবি অনেকটা বোকামি।

শান্তির যে ফুল এখনো ফোটেনি, তার জন্য কেন শান্তির নোবেল?