আর্থিক অনিয়মের গ্যাঁড়াকলে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর আইনজীবী

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

গত মাসে নিউইয়র্কের একটি ফেডারেল আদালতের অনুমতিক্রমে এফবিআই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকেল কোহেনের বাসভবন, অফিস ও হোটেল কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নথিপত্র জব্দ করে। এই ঘটনায় ক্রুদ্ধ হয়ে ট্রাম্প অভিযোগ করেছিলেন, আইনজীবী ও মক্কেলের সম্পর্ক সংরক্ষণের যে আইন রয়েছে, এই অভিযানে তা লঙ্ঘিত হয়েছে। ‘আইনজীবী ও মক্কেলের সুবিধা মৃত’—তিনি এক টুইটে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।

সে সময় ধারণা করা হয়েছিল, ব্যক্তিগত আইনজীবী হওয়ায় মাইকেল কোহেন ট্রাম্পের অনেক গোপন অনিয়ম, এমনকি বেআইনি কাজের খবর জানেন। এখন সেসব ফাঁস হতে পারে, সে কারণেই তিনি ক্ষিপ্ত। নামে আইনজীবী হলেও কোহেনের আসল কাজ ছিল ট্রাম্পের ‘জঞ্জাল’ সাফ করা। যেমন পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের মুখ বন্ধ রাখতে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলারের বিনিময়ে ‘অপ্রকাশ চুক্তি’ সম্পাদনের কাজটি কোহেনই করেন। ট্রাম্পের নতুন আইনজীবী রুডি জুলিয়ানি ইঙ্গিত করেছেন, আরও নারীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক লুকাতে কোহেন হয়তো স্টর্মি ছাড়াও একাধিক নারীকে অর্থ দিয়ে মুখ বন্ধ রেখেছেন।

এখন জানা যাচ্ছে, কোহেনের একটি প্রধান কাজ ছিল ট্রাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবেন, এই প্রতিশ্রুতিতে বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করা। এই লক্ষ্যে তিনি ইসেনশিয়াল কনসালট্যান্টস নামে একটি লোক-দেখানো কোম্পানি নিবন্ধিত করেন। স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে এই কোম্পানির মাধ্যমেই ‘মুখ বন্ধের’ অর্থ প্রদান করা হয়। যেসব কোম্পানি ট্রাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার আশায় কোহেনকে অর্থ জুগিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি রুশ মালিকানাধীন কোম্পানি, যারা কোহেনকে মোট পাঁচ লাখ ডলার প্রদান করে। যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত হলেও এই কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত আছেন এমন একজন রুশ বিলিয়নিয়ার, যাঁর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ ছাড়া এটিঅ্যান্ডটি, নোভারটিস ও কোরিয়া এয়ারস্পেসের মতো বিশাল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর কোহেনের অ্যাকাউন্টে প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন ডলার জমা দেয়। এক দিন আগে স্টর্মি ড্যানিয়েলসের আইনজীবী মাইকেল আভেনাতি অজ্ঞাত সূত্র থেকে প্রাপ্ত ব্যাংকের নথিপত্রের কপি ফাঁস করলে বিষয়টি ধরা পড়ে। ভাবা হচ্ছে, এর বাইরেও আরও অর্থ লেনদেনের ঘটনা থাকতে পারে।

এসব কোম্পানি কোহেনকে ‘কনসালট্যান্ট’ হিসেবে নিয়োগ করলেও এত বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে কোহেন কী সেবা দিয়েছেন, সে কথা কেউই খোলাসা করে বলতে পারেনি। একটি কোম্পানি স্বীকার করেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে সাহায্য করবেন, এই বিশ্বাসে কোহেনকে এই অর্থ প্রদান করা হয়, কিন্তু কাজটি ঠিক হয়নি। সমস্যা হলো, কোহেন লবিং করার জন্য তালিকাভুক্ত নন। তা সত্ত্বেও যদি এসব কোম্পানির পক্ষে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে লবিং করার প্রতিশ্রুতিতে অর্থ নিয়ে থাকেন, তাহলে সেটি হবে মার্কিন আইনবিরুদ্ধ।

প্রশ্ন উঠেছে, এই অর্থ কি একা কোহেনের পকেটে গেছে, না ডোনাল্ড ট্রাম্পও তার বখরা পেয়েছেন। নিউইয়র্কার পত্রিকা সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছে, কোহেনের লোক-দেখানো কোম্পানি কি আসলে ট্রাম্পের ‘স্লাস ফান্ড’ বা গোপন তহবিল, যার মাধ্যমে বিতর্কিত বিভিন্ন কাজ সারা হতো? যেমন কোহেনের মাধ্যমে পাওয়া এই অর্থ থেকেই কি স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার প্রদান করা হয়েছে? এই বিষয়ে সন্দেহ উসকে দিয়েছেন ট্রাম্পের আইনজীবী রুডি জুলিয়ানি, তিনি ফক্স টিভিকে জানিয়েছেন, ট্রাম্পের হয়ে আরও অনেক ব্যক্তিগত কাজ কোহেন সারতেন। তবে অর্থ যা-ই সে খরচ করুক না কেন, ট্রাম্প কোহেনকে পাই-পয়সা বুঝিয়ে দিতেন বলে মন্তব্য করেছেন জুলিয়ানি।

নিউইয়র্কার জানিয়েছে, ট্রাম্প বরাবরই অন্যের অর্থ নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন। বিভিন্ন কোম্পানি থেকে পাওয়া উৎকোচের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। শুধু তফাত হচ্ছে এই যে ট্রাম্প এখন আর ব্যবসায়ী নন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তাঁর জ্ঞাতসারে যদি কোহেন আলাপ করিয়ে দেওয়ার ছুতায় মোটা অর্থ বাগিয়ে থাকেন, তাহলে সেটি অপরাধমূলক কাজ বলে বিবেচিত হবে।

প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসও ট্রাম্পের অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সম্পাদকীয় পর্ষদের নামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে পত্রিকাটি ট্রাম্পের আয়-ব্যয়ের হিসাব জানার জন্য তাঁর বার্ষিক আয়কর বিবরণী প্রকাশের দাবি জানিয়েছে। তারা বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে—এমন একটি রুশ কোম্পানির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নেওয়ার ঘটনায়। পত্রিকাটি জানিয়েছে, ট্রাম্প তাঁর ব্যবসায়িক জীবনে বরাবর রুশ ও নগদ অর্থ—এই দুই নিয়ে কারবার করেছেন। ভালো খবর হলো, বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট ম্যুলার এখন উভয় প্রশ্নেই তদন্ত চালাচ্ছেন।