সেই আমার মা

উত্তরের নকশার পাঠকের জন্য পাখা হাতে মায়ের ছবি এঁকেছেন চিত্রশিল্পী তাজুল ইমাম।
উত্তরের নকশার পাঠকের জন্য পাখা হাতে মায়ের ছবি এঁকেছেন চিত্রশিল্পী তাজুল ইমাম।

সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল,
সেই গিয়েছে সবার আগে সরে।
ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে,
সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ছিন্নমুকুল’ কবিতার এই লাইনগুলো আমার মা রঙিন সুতোয় অ্যাম্ব্রয়ডারি করেছিলেন একটা হাত পাখায়। গ্রামের বাড়িতে হাতপাখাটি ছিল অনেক দিন। এখনো আছে কিনা জানি না। পাখাটি দেয়ালে ঝোলানো থাকত। মাকে দেখেছি অনেক দিন সেটির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে। এভাবেই মা তাঁর গভীর এক বেদনাকে বিমূর্ত করে রেখেছিলেন নিছক আটপৌরে একটি শিল্পকর্মের ভেতরে। আমরা ভাইবোনেরা এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতাম না, আবার উপেক্ষা করার মতো রুঢ়তাও আমাদের ছিল না। জীবন—সে যতই প্রখর সূর্য হোক, বেদনার সন্ধ্যার কাছে তাকে সমর্পণ করতেই হবে।
সেদিন স্কুল থেকে ফিরতেই মা এগিয়ে এলেন। তাঁর অবয়বে ব্যাকুলতা আর শঙ্কা, মণিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তুই একটু পুকুরে নাম। দুপুর থেকেই তাকে কেউ দেখেনি। বিশাল শরিকি বাড়ি, সবাই ভেবেছে কোথাও আছে নিশ্চয়ই, খেলায় মগ্ন। মায়ের মনে নিশ্চয়ই খারাপ কোনো আশঙ্কা কাজ করছিল।
আমার সহদোরা, সবচেয়ে আদরের ছোট বোন মণি। নাম জিজ্ঞেস করলে মুচকি হেসে বলত, মণিমালা। গ্রামের বাড়ির বিরাট আঙিনায় দিনভর ছুটোছুটি, শুপারি বাগানে লুকোচুরি, ভর দুপুরে বাড়ির পুকুরে উথালপাতাল সাঁতার অথবা বারান্দার এক কোণে বসে আপনমনে পুতুল খেলা—এই ছিল তার প্রাত্যহিক জীবন। শহর ছেড়ে গ্রামে এসে একঘেয়ে গ্রাম্য জীবনযাত্রায় আমরা যখন মৃয়মাণ সে তখন বুনো পাখির মতো উদ্দাম আনন্দে মাতোয়ারা।
আমার আগেই ফখরুল ভাই ঝাঁপিয়ে পড়লেন পানিতে। বেশি খুঁজতে হল না, শানবাঁধানো পিচ্ছিল ঘাটের পাশেই পাওয়া গেল আমাদের হারানো মণিমালাকে। জলমগ্ন ফ্যাকাশে প্রায় নীল হয়ে যাওয়া মুখে লেগে আছে অনন্ত ঘুমের আবেশ। সারা বাড়ি জুড়ে তখন হাহাকার, মা সংজ্ঞাহীন। অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে বাবা বাড়ি ফিরলেন তিনদিন পর। পানির তলায় প্রাণটা কী করে গেল গো মা—বাবার আহাজারি আজও কানে বাজে।
তারপর, বহুকাল কেটে গেল। কে যেন বলেছিল—প্রিয়জনেরা ভুলে গেলেই মানুষের আসল মৃত্যু হয়। আমরা ভুলে গেছি মণিমালাকে। ওর ছোটবেলার খেলার সাথীরাও ওকে মনে রাখেনি। কচিৎ কখনো দেশে ফিরলে মাকে দেখতে যাই গ্রামের বাড়িতে, সন্ধ্যার আলোছায়ায় জৈন্তা পাহাড়ের ছায়া পড়ে আমাদের দিঘির পানিতে, শুপারি গাছ আর নুয়েপড়া কলাগাছ মুখ দেখে দিঘির আয়নায়। আমের নিবিড় কুঞ্জ ঘরেফেরা পাখিদের কাকলিতে মুখর। বাতাসে ফিস ফিস, ‘ভাইয়া আমার চকলেট এনেছ?’ মুখখানাও আর মনে পড়ে না।
মা কিন্তু ভুলেননি। তালা দেওয়া আয়রন চেস্টের ভেতরে ন্যাপথলিন দেওয়া কাপড়ের আড়ালে একটা বিস্কুটের টিনের ভেতর দুটো পুতুল, দু চারটে কাঁচের চুড়ি, পাথরগুটি খেলার নুড়ি পাথর, দু একটা পুঁতির মালা—মণিমালার খেলাঘরের সংসার। ৫০ বছর পার হয়ে গেল—মা আগলে রেখেছেন বুকের অনেক গভীরে লুকিয়ে রাখা বেদনার মতো।
সেই তো আমার মা। চিরন্তন মায়ের ছবি। আজও হৃদয়ের গহিনে লুকিয়ে রেখেছেন ছোট্ট সেই মণিমালাকে।
বহুকাল আমি ঘর ছাড়া। বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে আছি আজ ৩৭ বছর ধরে। জীবন চলার পথে অনেক মায়ের ভালোবাসা পেয়েছি। দেখেছি অনেকে মায়ের সংগ্রামকে। আমার স্ত্রী স্বপ্নাও একজন আদর্শ মা।
জগতের সব মাকে, বিশ্ব মা দিবসের শুভেচ্ছা।