কিছু অবৈধ অভিবাসী অমানুষ: ট্রাম্প

ক্যালিফোর্নিয়ার আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প
ক্যালিফোর্নিয়ার আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, কিছু অবৈধ অভিবাসী মানুষ নয়, এরা জানোয়ার। আমেরিকায় এর আগে দেখা যায়নি, এমনভাবেই এদের বিতাড়ন করা হবে। ১৬ মে ক্যালিফোর্নিয়ার আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেছেন। অবৈধ অভিবাসী হিসেবে এমএস-১৩ গ্যাং সম্পর্কে কথা বলার জের ধরেই তিনি এসব কথা বলেছেন।
অভিবাসীদের নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন নগ্ন বক্তব্য আগেও দিয়েছেন। এবার সরাসরি অমানুষ আর জানোয়ার হিসেবে উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর মনোভাবের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ করেছেন।
আমেরিকায় বৈধ ও অবৈধ-সব অভিবাসনই কঠিন করে তুলেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বেশ শক্ত পথেই হাঁটছেন তিনি। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা এখনো ঝুলে আছে। ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই বলে আসছিলেন, বৈধ অভিবাসনের পক্ষে তিনি। বন্ধ করবেন অবৈধ অভিবাসন। বাস্তবে তিনি বৈধ অভিবাসনই নানা কড়াকড়ি আরোপ করে কঠিন করে তুলছেন। নানা ফন্দি ফিকির আর লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে আমেরিকায় বৈধ অভিবাসনও এখন কঠিন হয়ে উঠেছে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আমেরিকায় আসা কঠিন করছেন, কর্মী ভিসায় আসা নিয়ে নানা শর্ত আরোপ করছেন, এমনকি আমেরিকার নাগরিকের স্বামী-স্ত্রীর অভিবাসনের জন্য বর্তমানের চেয়ে নয় গুন দীর্ঘ ফরম পূরণের নিয়ম করে দেওয়া হচ্ছে। সব মিলে বাইরের দেশ থেকে আমেরিকায় অভিবাসন এখন কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করে অভিবাসী গ্রুপগুলো। 

অভিবাসনের এইচ ১-বি ভিসার জন্য নানা বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে নিয়োগ কর্তাদের ওপর। যাতে খুব সহজে বাইরে থেকে কর্মী নিয়ে আসা সম্ভব না হয়। চাকরি দাতা এবং গ্রহীতার জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা এবং নীতিমালা কঠিন করার কারণে ২০১৬ সালের চেয়ে গত বছর এ ক্যাটাগরিতে আবেদনকারীর সংখ্যা ২০ শতাংশ কমে গেছে।
আগে এইচ-৪ ভিসা নামে পরিচিত ভিসায় আগত লোকজনের ওয়ার্ক পারমিট ছিল। যারা দক্ষ কর্মী হিসেবে এইচ-১ ভিসায় আমেরিকায় আসে, তাদের স্বামী বা স্ত্রীকে এ ভিসা দেওয়া হয়। ওবামা প্রশাসনের সময় এ ধরনের ভিসাধারীদের কাজের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসন তাদের কাজের অনুমতি বাতিল করে দেওয়ার ফলে ৯১ হাজার এইচ-৪ ভিসাধারীর এখন কাজের অনুমতি নেই। কর্মহীন এসব লোকজনকে স্বদেশে ফিরে যেতে হবে। অন্যথায় স্বামী বা স্ত্রী একজনের কাজের ওপর নির্ভর করে থাকতে হবে আমেরিকায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ২০১৭ সালে প্রায় ১৭ শতাংশ কমে গেছে। সম্ভবত এই বছর আরও কমবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার একটি প্রধান সুবিধা হলো স্নাতক ডিগ্রির পরে এখানে কাজ করার ক্ষমতা অর্জন। ছাত্র ভিসায় আসা শিক্ষার্থীরা আইনত তাদের ডিগ্রি অর্জনের পর ১২ মাসের জন্য আইন অনুযায়ী কাজ করতে পারেন। ঐচ্ছিক প্র্যাকটিক্যাল প্রশিক্ষণ নামে একটি প্রোগ্রামের অধীনে তিন বছর থাকতে পারেন। ২০১৬ সালে প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী এ কর্মসূচিতে নাম তালিকাভুক্ত করে। এই কর্মসূচিকে এইচ-১ বি ভিসার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মনে করা হয়।
বিদেশি ছাত্ররা এখন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এইচ-১ ভিসা সীমিত করবেন বলে। বছরে প্রায় ৬৩ হাজার ডলার ব্যয় করে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এখানে চাকরি পাওয়ার ভরসা পাচ্ছেন না এখন বিদেশি শিক্ষার্থীরা।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত বছরে পুরো শরণার্থী কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্থগিত করেন। দাবি করেন, সন্ত্রাসীরা শরণার্থী হিসেবে দেশটিতে প্রবেশ করবে। শরণার্থী আগমন বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলে ২০১৬ সালের তুলনায় আমেরিকায় শরণার্থী আগমন ৭৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার নিজ উদ্যোগে শরণার্থী গ্রহণ এবং এদের ব্যয়ভার মিটানোর একটি কর্মসূচিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাতিল করে দিয়েছেন।
সন্ত্রাসবাদকে প্রতিরোধ করতে তথাকথিত মুসলিম নিষিদ্ধকরণের একটি কারণ বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নানা সময় উল্লেখ করে আসছেন। এক নির্বাহী আদেশে কয়েকটি মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নাগরিকসহ উত্তর কোরিয়া ও ভেনেজুয়েলার নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রাপ্তি সীমিত বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়ার কথা ছিল। আদালত এ নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও নিষেধাজ্ঞা এবং এ সম্পর্কিত নীতিগুলোর একটি বড় প্রভাব রয়েছে। সব ধরনের শরণার্থী সংখ্যা ২০১৬ সালের চেয়ে কম হলেও আমেরিকায় মুসলমান শরণার্থীদের সংখ্যা ৯১ শতাংশ কমে গেছে। মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মানুষের অভিবাসী ভিসা ২৬ শতাংশের নিচে এবং মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে পর্যটক ভিসায় আসা মানুষের সংখ্যা ৩২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
গত বছর, প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী রেক্স ডব্লিউ টিলারসন সব অভিবাসী এবং পর্যটকদের জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তা স্ক্রিনিং করার আদেশ দিয়েছিলেন। সন্ত্রাসবাদীদের নজরদারি করার উপায় হিসেবে একটি পদক্ষেপ বলেও এ স্ক্রিনিংকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নি শাবানম লুলফী বলেছেন, এই পদ্ধতিগুলো ভিসা আবেদনকারীদের জন্য আগেই কার্যকর ছিল। আগে এই পদ্ধতিতে যাচাই করার পরও আবেদনকারীর জন্য ভিসা প্রাপ্তিতে ব্যয়বহুল বিলম্বের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে নতুন স্ক্রিনিং পদ্ধতি।
ট্রাম্প প্রশাসন সরাসরি ও পরোক্ষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়ের জন্য বিদেশিদের নিরুৎসাহিত করেছে। ২০১৩ সালের তুলনায় ভেনেজুয়েলার নাগরিকদের ৭৪ শতাংশের বেশি ভিসার সংখ্যা কমেছে। এ দেশটি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু ভেনেজুয়েলার নাগরিকদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের অনুরোধ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হবে এবং তারা ভিসা ছাড়া এখানে আসতে পারবেন না। এদিকে আমেরিকার দক্ষিণ সীমান্তে পৌঁছে যারা আশ্রয়ের আবেদন বা চেষ্টা করছেন, তাদের পরিবার বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। মধ্য আমেরিকার আশ্রয় প্রার্থীদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। সরকার বিভিন্ন ইমিগ্রেশন আটক কেন্দ্রে বাবা-মা এবং সন্তানদের বিচ্ছিন্ন করে আবেদন বিবেচনার জন্য দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নেয়।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এরই মধ্যে বলেছেন, তিনি ২০২০ সালের মধ্যে বেশ কিছু অভিবাসীর প্রোটেক্টেড স্ট্যাটাস বাতিল করে দেবেন। এ ধরনের প্রায় সাড়ে চার লাখ অভিবাসীর মধ্যে এল সালভাদর, হন্ডুরাস, হাইতি ও নেপালের অধিকাংশ লোকজন রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর তাদের আইনগতভাবে এখানে বসবাস করতে দেওয়া হয়। এসব অভিবাসীর ৮০ শতাংশেরই আমেরিকায় চাকরি রয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৭৩ হাজার জনের জন্ম আমেরিকায়। কয়েক দশক ধরে তারা এখানে বসবাস করছেন। এখনই চলে যেতে হবে কি না—এ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে এসব অভিবাসীর। এর আগে সালভাদরের নাগরিকদের ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে অস্থায়ী প্রোটেকশন বাতিল করা হলেও তারা আমেরিকা ছেড়ে যাননি।
ইমিগ্রেশন নিয়ে শুধু এসব খেলাই হচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কংগ্রেসে রক্ষণশীলদের উত্থাপিত ‘রেইজ অ্যাক্ট’ নামের একটি আইন প্রস্তাবের প্রতিও সমর্থন করছেন। এ আইনটি পাস হলে আমেরিকায় বৈধ অভিবাসন এমনিতেই ৫০ শতাংশ কমে যাবে। ডেফার্ড অ্যাকশন বা ডেকা নামের এই কর্মসূচিতে আটকেপড়া অভিবাসীরা এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। যারা অপ্রাপ্ত বয়সে আমেরিকায় এসে এ দেশকেই নিজের দেশ মনে করে মিশে গেছেন, তাদের নিয়ে আমেরিকায় ইমিগ্রেশন রাজনীতি খেলছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অর্থনৈতিক চাঞ্চল্যের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর কথা বলছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্য তাকে আইনগত অভিবাসী, উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী এবং শ্রমিক দরকার। বিশেষ করে বেকারত্বের হার আমেরিকায় এখন চার শতাংশের নিচে। আমেরিকার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো এর মধ্যেই কর্মী সংকটে ভুগছে। দক্ষ কর্মীর অভাবে অনেক প্রতিষ্ঠানে এর মধ্যেই সংকট দেখা দিয়েছে।
আমেরিকার কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের কাছে ‘ইমিগ্রেশন পুলিশ’ এখন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। প্রতিদিন কোনো না কোনো জায়গায় এরা তল্লাশি চালাচ্ছেন। তল্লাশি চলছে কর্মক্ষেত্রেও। লোকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আদালতে হাজিরা দেওয়ার প্রাক্কালেও।
‘মেক আমেরিকা গ্রেট’ বলে অভিবাসীদের দেশ হিসেবে পরিচিত আমেরিকাকে অভিবাসী বিরোধী হিসেবে পরিচিত করছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকার অর্থনীতির চাকা সচল রাখা বা অর্থনৈতিক চাঞ্চল্যের জন্য বৈধ অভিবাসন ছাড়া, জনশক্তির অবাধ প্রবাহ ছাড়া লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়—এমন মন্তব্য করেছে শিকাগো ট্রিবিউন নামের প্রভাবশালী পত্রিকাটি।
এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এমন অভিবাসী বিরোধিতা নিয়ে কথা বলেছেন ডেমোক্র্যাট দলের সিনেটর এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বার্ণি সেন্ডার্স। গত সপ্তাহান্তে সিএনএনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইমিগ্রেশন নিয়ে ট্রাম্পের পুরো দৃষ্টিভঙ্গি নিষ্ঠুর। পরিবার ও সন্তানদের বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। আমেরিকা এমন হৃদয়হীন আচরণ করতে পারে না বলে তিনি সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন।