বাই বাই রোজেন

২০ বছর অনুপস্থিত থাকার পর ফের শুরু হওয়া জনপ্রিয় সিটকম (সিচুয়েশন কমেডি) ‘রোজেন’ মাত্র এক সিজন চলার পরই বাতিল হয়েছে। টুইটারে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাবেক উপদেষ্টা ভ্যালেরি জ্যারেটকে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ ও ‘বানরের’ সঙ্গে তুলনা করার পর যে হুলুস্থুল কাণ্ড হয়, তারপর অনেকটা বাধ্য হয়েই এবিসি টিভি সিরিজটি বাদ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। বলা বাহুল্য, জ্যারেট মুসলিম বা বানর কোনোটাই নন। তিনি একজন আফ্রিকান আমেরিকান।

রোজেনের মুখে বর্ণবাদী মন্তব্য আমরা আগেও শুনেছি, কিন্তু তা তেমন কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করেনি। তিনি কমেডিয়ান বটে, কিন্তু তাঁর অন্য পরিচয় আছে-রোজেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক। তাঁর কুৎসিত মন্তব্যে অনেকে ট্রাম্পের ছায়া দেখতে পেয়েছেন।

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই দেশে বর্ণভিত্তিক উত্তেজনা বহুগুণে বেড়ে গেছে। সব ধরনের সংখ্যালঘু, তা সে মুসলিম, আফ্রিকান-আমেরিকান বা মেক্সিকান যে-ই হোক, এখন আক্রমণের শিকার। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে সব সংখ্যালঘু, এমনকি প্রতিবন্ধীকে নিয়ে বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেছেন। তাঁর নিজের অভাবিত বিজয়ের একটা বড় কারণই ছিল সংখ্যালঘুদের প্রতি, বিশেষত মুসলিম ও মেক্সিকানদের প্রতি, কঠোর সমালোচনা।

কিন্তু সে জন্য এবিসি টিভিকে একটি জনপ্রিয় সিটকম বাতিল করতে হবে কেন? সিটকমটিতে রোজেনের ভূমিকা ছিল একজন স্বল্পশিক্ষিত ও স্বল্পবিত্তশালী শ্বেতকায় আমেরিকানের চরিত্র। ভাবা হয়, এদের ভোটেই ট্রাম্প জিতেছেন। সে কথা জানার পরেও এবিসিকে সিরিজটি বাতিল করতে হয় মূলত বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপের কারণে।

এবিসির সাবেক কর্মকর্তা প্রেস্টন বেকম্যান মনে করেন, সামাজিক চাপে বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রস্থান শুরু হতো, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই বয়কট যাতে শুধু এবিসি টিভির মধ্যেই সীমিত থাকে, এই কোম্পানির অন্যান্য কর্মকাণ্ডে প্রসারিত না হয়, সে জন্যই তড়িঘড়ি করে সিরিজটি বাদ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। উল্লেখযোগ্য, ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি এবিসি টিভির মালিক।

রোজেনের ঘটনা থেকে আরেকবার প্রমাণিত হলো, একটা সাদা-কালো বিভক্তি এখনো আমেরিকাকে দুটো দেশ বানিয়ে রেখেছে। কালোদের প্রতি অথবা ভিন্ন বর্ণের মানুষদের এ দেশের শ্বেতকায়দের একাংশ এখনো ঠিক মানুষের পূর্ণ মর্যাদা দেয় না। যেমন কয়েক সপ্তাহ আগে স্টারবাকস নামক কফির দোকানে দুই কালো মানুষ কোনো কিছু না কিনে বসে ছিল। তা দেখে সে দোকানের ম্যানেজার পুলিশ ডেকে তাদের ধরিয়ে দিয়েছিল।

শুধু স্টারবাকস বা এবিসিতেই নয়, আমেরিকাজুড়েই এই ঘটনা ঘটছে। পুলিশের হাতে শুধু কালো হওয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছে অথবা গুলিতে মরেছে, এমন ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক। এই বর্ণবাদী মনোভাব সাধারণ মানুষদের মধ্যেও প্রবল। কিছুদিন আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় এক ভাড়া বাড়িতে তিন কালো নারীকে দেখে তাঁদের চোর ভেবে এক প্রতিবেশী সাদা নারী পুলিশ ডেকে বসেন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে এক কালো মেয়েকে ঘুমাতে দেখে দুই সাদা ছাত্র ক্যাম্পাস পুলিশ ডেকে জানায়, মেয়েটির এখানে থাকার কথা নয়, তবুও সে বসে আছে। অথচ মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী। নর্থ ক্যারোলাইনায় বেলা তিনটার সময় জোরে গান শোনার অপরাধে এক আফ্রিকান-আমেরিকান যুবককে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ ডেকে আনে তাঁর শ্বেতকায় প্রতিবেশীরা। একই কাণ্ড হয় ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে পার্কে। সেখানে একদল কালো মানুষ বারবিকিউ করছিল। হঠাৎ পুলিশ এসে হাজির, এক সাদা নারী জানিয়েছিলেন, এরা অবৈধভাবে এখানে পিকনিক করছে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি আমেরিকার দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও যে মানসিকতা এই অমানবিক অবস্থার জন্ম দেয়, এত দিন পরেও তার পরিবর্তন হয়নি, এসব ঘটনা সে কথার প্রমাণ। নিউইয়র্ক টাইমসের কলাম লেখক চার্লস ব্লো মন্তব্য করেছেন, আসলে শ্বেত আমেরিকার একটা বড় অংশ এখনো কালো বা অন্য বর্ণের মানুষদের পুরোপুরি মানুষ বলে মনে করে না। এদের চোখে তাঁরা ভিন্ন এক প্রজাতি।

তবে সামান্য হলেও অবস্থা বদলাচ্ছে, রোজেনের সিটকম বাতিল হওয়া তার প্রমাণ। পরিহাসের বিষয় হলো, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর চেয়েও নোংরা কথা বলেছেন। তা সত্ত্বেও তিনি এখনো হোয়াইট হাউসে বহাল তবিয়তেই সমাসীন।