শিশুদের বিচ্ছিন্ন করে বিবেকের কাঠগড়ায় ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

সাত মিনিটের একটি অডিও টেপ এখন বিশ্ব বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনকে।

যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে অবৈধ অভিবাসীদের সঙ্গে আগত শিশুদের বিচ্ছিন্ন করার যে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের সিদ্ধান্ত ট্রাম্প প্রশাসন গ্রহণ করেছে, তা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহলের তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছে। রিপাবলিকান পার্টির ভেতরেই অনেকে শিশুদের খাঁচার ভেতরে আটকে রাখার এই নীতিকে সব সভ্য নিয়মের লঙ্ঘন বলে তার সমালোচনা করেছেন। এমনকি ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প এই ব্যবস্থা অনৈতিক বলে নির্দেশ করেছেন।

অডিও টেপটি সেই নিন্দা ও সমালোচনায় নতুন রসদ তুলে দিয়েছে। প্রো-পাবলিকা নামের একটি অলাভজনক বার্তা সংস্থা কর্তৃক প্রচারিত এই টেপে সীমান্ত এলাকায় অভিভাবকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন শিশুদের বিরামহীন কান্নার ধ্বনি শোনা যায়। সবার প্রশ্ন, তাদের মা-বাবা কোথায়। একটি শিশু তার খালার ফোন নম্বর শুনিয়ে বারবার বলছে, সে বাসায় যেতে চায়। সাহায্যকর্মীরা শিশুদের কান্না থামাতে চেষ্টা করেও তাদের শান্ত করতে পারছে না।

অবৈধ অভিবাসন বন্ধের চেষ্টায় ট্রাম্প প্রশাসন যে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেটি ওবামা আমলে গৃহীত আইনের ফল বলে দাবি করেছেন। ‘এটি একটি জঘন্য আইন, কিন্তু এর জন্য আমি দায়ী নই,’ তিনি দাবি করেছেন। অথচ শিশুদের বিচ্ছিন্ন করার কোনো আইন কংগ্রেস কখনোই গ্রহণ করেনি। ওবামা প্রশাসনও এমন কোনো নীতি অনুসরণ করেনি। ২০১৪ সালে এ-জাতীয় একটি প্রস্তাব ওবামার হোয়াইট হাউসে আলোচিত হয়েছিল, কিন্তু তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আইনমন্ত্রী জেফ সেশন্স ও ট্রাম্পের অন্যতম উপদেষ্টা স্টিভেন মিলার এই নিয়মের পক্ষে ওকালতি করে আসছেন। সেশন্স এমনকি বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ঈশ্বর এই নিয়মের পক্ষে। আমেরিকার খ্রিষ্টান নেতৃবৃন্দ অবশ্য সে দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ঈশ্বর কোনো পরিবার বিভক্ত করার পক্ষে নন। তিনি চান, প্রতিটি পরিবার একত্রে থাকুক।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মুখের একদিক দিয়ে এই ব্যবস্থার সমালোচনা করলেও মুখের অন্যদিকে দিয়ে তিনি এই নিয়মের সমর্থনে জোর আওয়াজ তুলেছেন। গতকাল মঙ্গলবার তিনি দাবি করেন, অভিবাসীদের অবাধ আগমনের ফলে যুক্তরাষ্ট্র বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। শিশুদের বিচ্ছিন্ন করার নতুন নিয়মের কথার উল্লেখ করার বদলে তিনি সব দোষ চাপান মা-বাবার ওপর। তাঁরা কী করে নিজেদের ছেলেমেয়েদের এভাবে নিয়ে আসতে পারেন, সেই প্রশ্ন তোলেন। এর আগে হোমল্যান্ড সিকিউরিটিমন্ত্রী কিরস্টেন নেলসন অভিযোগ করেন, অভিবাসীরা বানের জলের মতো এসে ঢুকছে আমেরিকায়।

ট্রাম্পের নিজের দলের ভেতরেই অনেকে শিশুদের বিচ্ছিন্ন করার নিয়মের তীব্র সমালোচনা করেছেন। ফ্লোরিডার রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য ইলেনা রস-লেতিনেন এক টুইটে বলেন, অভিবাসীরা আমেরিকা বিষাক্ত করে তুলছে বলে ট্রাম্পের অভিযোগ জঘন্য ও নিন্দনীয়। একজন ক্যাথলিক যাজক বলেছেন, ‘আমরা পশুদের কথা বলার সময়েই বিষাক্ত কথাটা ব্যবহার করি। ট্রাম্পের এই শব্দের ব্যবহার নাৎসি জার্মানির সঙ্গে তুলনীয়, সেখানে ইহুদিদের আরশোলার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল।’

শিশুদের মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার বিরুদ্ধে মার্কিন ও আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে টেক্সাসভিত্তিক একটি ইমিগ্রেশন সেন্টারের পরিচালক জনাথন রায়ান বলেছেন, এই নির্মম আইন প্রয়োগের একটিই উদ্দেশ্য, আর তা হলো মার্কিন নাগরিকদের মনে অবিচারের প্রতি চোখ ফিরিয়ে নিতে উৎসাহিত করা। ওবামা আমলের হোমল্যান্ড সিকিউরিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী জ্যানেট নেপোলিতানো মন্তব্য করেছেন, আইনত অথবা নীতিগত, কোনোভাবেই এই নিয়মকে সমর্থন করা যায় না।

এই ক্ষতিকর নিয়ম অবিলম্বে বন্ধের জন্য কংগ্রেসে রিপাবলিকান নেতৃত্বের ওপর চাপ বাড়ছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ এই নীতির বিরুদ্ধে। শিশুদের মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের খাঁচার ভেতর রাখা হচ্ছে, দেশ হিসেবে এমন একটি ছবি অত্যন্ত ক্ষতিকর, বলেছেন রিপাবলিকান কংগ্রেসনাল জাতীয় কমিটির প্রধান স্টিভ স্টাইভারস। ‘বাবা হিসেবে এই দৃশ্য দেখে আমি উদ্বিগ্ন,’ স্টাইভারস বলেছেন।

ট্রাম্প-সমর্থক হিসেবে পরিচিত রক্ষণশীল ভাষ্যকার হিউ হিউইট শিশুদের বিচ্ছিন্নতার ফলে যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তাকে ট্রাম্পের ‘ক্যাট্রিনা’ নামে অভিহিত করে বলেছেন, নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফল রিপাবলিকানদের পোহাতে হবে। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেও গতকাল এক ভাষণে স্বীকার করেন, ক্রন্দনরত শিশুদের চিত্র রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর।

এই অবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে মার্কিন কংগ্রেসে একাধিক খসড়া আইন বিবেচনাধীন রয়েছে। এর একটির প্রস্তাব করেছেন টেক্সাসের সিনেটর টেড ক্রুজ। তিনি প্রস্তাব করেছেন, গ্রেপ্তারকৃত অভিভাবকদের সঙ্গে শিশুদেরও একই জেলখানায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ওরেগন থেকে নির্বাচিত ডেমোক্রেটিক সিনেটর জেফ মেরকেল সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ‘একজনের বদলে এখন দুজনকেই হাতকড়া পড়ানো হোক, সেটি কেমন করে এই সমস্যার সমাধান আমার মাথায় ঢোকে না।’ তিনি মনে করিয়ে দেন, এই সমস্যার কারণ ট্রাম্পের নীতি। ট্রাম্প চাইলে এক মুহূর্তেই সে নিয়ম বাতিল করতে পারেন।