
ডোনাল্ড ট্রাম্প রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন একজন বহিরাগত হিসেবে। ক্ষমতা গ্রহণের ১৮ মাসের মধ্যে তিনি আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন। অনেকেই বলছেন, ট্রাম্প শুধু প্রেসিডেন্ট হয়ে সন্তুষ্ট নন, তিনি সম্রাট হতে চান। সিএনএন ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন নামকরণ করেছে ‘ইম্পিরিয়াল প্রেসিডেন্সি’।
মার্কিন শাসনব্যবস্থার দুই খুঁটি—হোয়াইট হাউস ও কংগ্রেস উভয়ের ওপর ট্রাম্পের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। বিচারব্যবস্থাও তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছেন। রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের সাহায্যে তিনি ইতিমধ্যে ফেডারেল আদালতগুলোতে নিজের পছন্দমতো বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে পুরো বিচারব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। গত সপ্তাহে বিচারপতি অ্যান্টনি কেনেডির অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর সুপ্রিম কোর্টের গঠন সম্পূর্ণ বদলে দেওয়ার সুযোগও তাঁর সামনে হাজির। ওয়েব পত্রিকা হাফিংটন পোস্ট খোলামেলাভাবেই লিখেছে, গত সপ্তাহটা ছিল ট্রাম্পের জন্য সেরা সপ্তাহ, কিন্তু আমেরিকার জন্য সবচেয়ে খারাপ সপ্তাহ।
প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটদের জন্য অবস্থাটা এতটাই হতাশাগ্রস্ত যে নিউইয়র্কের বামঘেঁষা ডেইলি নিউজ এক প্রচ্ছদকাহিনির শিরোনাম দিয়েছে, ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে’।
ভাষ্যকারেরা বলছেন, কংগ্রেস ও রিপাবলিকান পার্টির ওপর ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণ এখন নিরঙ্কুশ। তিনি এদের সবার মতামত উপেক্ষা করে যা খুশি করতে পারেন। বিচার বিভাগ ক্ষমতার অপব্যবহার ঠেকাতে প্রহরীর দায়িত্ব পালন করবে—এমন আশা যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের আশার প্রদীপও দ্রুত নিভে আসছে। গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট ৫-৪ ভোটে মুসলিমপ্রধান দেশগুলো থেকে পর্যটকদের আগমন ঠেকাতে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ আইনসম্মত বলে রায় দিয়েছেন। তা থেকে স্পষ্ট এই আদালত ট্রাম্পের বিরুদ্ধাচরণ করতে অনাগ্রহী। খ্যাতনামা ভাষ্যকার মাইক অ্যালেন ওয়েব পত্রিকা এক্সিওসে লিখেছেন, তাঁর ক্ষমতার ওপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ট্রাম্প এখন আমেরিকার ইতিহাসে সর্বাধিক ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট। সর্বশেষ বাধা ছিল তথ্যব্যবস্থা। কিন্তু গত দুই বছর ট্রাম্প যেভাবে পুরো তথ্যব্যবস্থাকে ‘ফেক নিউজ’ নামে আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে গেছেন, তাতে দেশের অধিকাংশ মানুষ এখন আর মিডিয়ার প্রতি আস্থা পোষণ করে না। ফলে মিডিয়ার সমালোচনা উপেক্ষা করে তাঁর যা খুশি করা ঠেকাতে পারে, এমন আর কেউ থাকল না।
মাইক অ্যালেন ট্রাম্পের স্কোর কার্ড উল্লেখ করে বলেছেন, বিশাল কর হ্রাস আইন পাসের পর করপোরেট আমেরিকা এখন তাঁর ওপর বেজায় খুশি। নিরাপত্তা বিভাগগুলো প্রথমে আপত্তি করলেও এখন তারা ট্রাম্পের দেখানো পথেই চলছে। অতিরক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রতি সমর্থন দেওয়ায় তাঁর প্রতি দেশের রক্ষণশীল ভোটাররাও খুশি। এককথায়, ট্রাম্প দেশের নিরাপত্তা প্রশ্নে রক্ষণশীল, অর্থনীতি প্রশ্নে রক্ষণশীল ও সামাজিক প্রশ্নে রক্ষণশীল, এমন সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন।
অনেকেই আশা করেছিলেন, রিপাবলিকান পার্টির ভেতরে কেউ কেউ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের বল্গাহীন ক্ষমতা দখলের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সক্ষম হবেন। প্রথম প্রথম কোনো কোনো সিনেটর, যেমন ম্যাককেইন বা জেফ ফ্লেইক প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিবাদের মুখে তাঁদের অধিকাংশই ঝরে পড়েছেন। কেউ কেউ এতটাই বিপদগ্রস্ত যে ট্রাম্পের রোষানলে পড়ার বদলে রাজনীতি থেকে বিদায়ের পথ গ্রহণ বেশি সম্মানজনক বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ওয়েব পত্রিকা বাজফিডের এলেক্সিজ লেভিনসন লিখেছেন, রিপাবলিকান পার্টি এখনো পুরোপুরি ট্রাম্পের থাবার নিচে। এই দলের প্রায় সব নেতার একটাই লক্ষ্য, কে ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় সমর্থক, ট্রাম্পের চেয়েও বেশি ট্রাম্পিয়ান, তা প্রমাণ করা। তিনি সম্প্রতি নিউইয়র্কের স্টাটেন আইল্যান্ডে রিপাবলিকান দলের বাছাই পর্বের নির্বাচনের উদাহরণ দিয়েছেন। কংগ্রেসের একটি আসনের জন্য যে দুজন প্রার্থী এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাঁরা উভয়েই নিজেদের ট্রাম্পের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে প্রমাণে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ী হলেন সেই ব্যক্তি, যাঁকে ট্রাম্প সমর্থন দিয়েছিলেন।
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেঞ্জামিন গিন্সবার্গ মনে করেন, পেশাদার রাজনীতিক ও চলতি রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি শ্বেত আমেরিকার অনাস্থা এতটাই তীব্র যে তারা ট্রাম্পের ব্যবহারে অগণতান্ত্রিক অথবা বিব্রতকর কিছুই দেখে না। এরাই ট্রাম্পের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলে উৎসাহ দিচ্ছে। বর্তমানে রাজনৈতিক বিভাজন এত তীব্র যে ট্রাম্পের নিজের দলের ভেতর এখন এমন একজনও নেই যিনি তাঁর বিরোধিতা করবেন। এমন কোনো সিনেটর নেই যিনি ট্রাম্পকে গিয়ে বলবেন, অনেক হয়েছে, আর নয়।