'প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে জানে', জাতিসংঘে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন

জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ফোরামে (এইচএলপিএফ) বক্তব্য দিচ্ছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। ছবি: সংগৃহীত
জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ফোরামে (এইচএলপিএফ) বক্তব্য দিচ্ছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। ছবি: সংগৃহীত

প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে জানে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ সেই সক্ষমতা অর্জন করেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) বাস্তবায়নের সফল অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) পূরণে কাজ করছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ফোরামে (এইচএলপিএফ) বিভিন্ন দেশের বক্তব্যের পর্যায়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে এসব কথা বলেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। প্রতিপাদ্য ছিল, ‘টেকসই ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম সমাজে রূপান্তর।’ ৯ জুলাই থেকে এই ফোরামের বৈঠক শুরু হয়। মন্ত্রী পর্যায়ের ঘোষণা গ্রহণের মধ্য দিয়ে ১৮ জুলাই বৈঠক শেষ হয়। ১৬ জুলাই মন্ত্রী পর্যায়ের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অংশ নেন।

গতকাল দেশ পর্যায়ের সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নে প্রথম আনুষ্ঠানিক দলিল হিসেবে বাংলাদেশে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর জন্য লক্ষ্য অনুসারে নির্দিষ্ট মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। জাতীয় কর্মপরিকল্পনাও প্রস্তুত করা হয়েছে। এসডিজি ও অন্যান্য জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যের বাস্তবায়ন নিরীক্ষণের জন্য একটি ডেটা সংগ্রহস্থল তৈরিতে এসডিজি ট্রাকার সৃষ্টি করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এ পরিণত করতে সরকার ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেছে।
এসডিজি বাস্তবায়নে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘পুঁজির সরবরাহ’, ‘ডেটা গ্যাপ’, ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে বৈষম্য মোকাবিলা ও উপযুক্ত চাকরির বাজার সৃজন’ ইত্যাদি ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাব বাংলাদেশের কৃষি খাত ও খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। 
রাষ্ট্রদূত বলেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন খাতে ব্যাপক সংস্কারের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে নতুনভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সুবিধা নেওয়া যায়। কিন্তু এতে বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন। বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি উন্নয়ন ও বাণিজ্য অংশীদারদের এসডিজি বাস্তবায়নে সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

চূড়ান্ত ঘোষণায় যা আছে
এবারের এইচএলপিএফের বৈঠকে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকোসক) প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়াকে এই ফোরামের মন্ত্রী পর্যায়ের ঘোষণার খসড়া তৈরির জন্য ‘সহ-সহায়তাকারী’ নিয়োগ করে। বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার তৈরি খসড়া প্রতিবেদন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পর্যালোচনার মাধ্যমে গতকাল চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়।
এবারের মন্ত্রী পর্যায়ের ঘোষণায় যে বিষয়গুলো প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তা হলো: অ্যাজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর আর্থিক, কারিগরি ও অন্যান্য সহযোগিতা দেওয়া। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নসহ অন্য সব বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের জন্য সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন ইস্যুতে রাষ্ট্রগুলোর বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন। অ্যাজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আদ্দিস আবাবা অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ। এসডিজির লক্ষ্য পূরণে ৬, ৭, ১১, ১২, ১৫ ও ১৭—এই ধারাগুলো বাস্তবায়নে অধিকতর গুরুত্বারোপ এবং এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়া। এসডিজি-১৭-এর অধীনে বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা কার্যকর করতে জোরালো ভাষায় সমর্থন দেওয়া। প্রযুক্তি খাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর সহায়তা দেওয়া।

ফোরামের সভায় বাংলাদেশের অন্যান্য আয়োজন
এইচএলপিএফ উপলক্ষে মূল বৈঠকের পাশাপাশি একাধিক সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ। ‘পয়োনিষ্কাশনে অংশগ্রহণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি: বাংলাদেশ থেকে শেখা’ ‘ডেটা বিপ্লবে পেছনে পড়ে থাকবে না কেউই’ এবং ‘টেকসই উত্তরণের লক্ষ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণ—পথ নির্বিঘ্ন করতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে সহযোগিতা প্রদান ’ শীর্ষক আলোচনায় যোগ দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়নবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ, স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব জাফর আহমেদ খান, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব কাজী শফিকুল আযম এবং সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাসহ শিক্ষাবিদ, উন্নয়নকর্মী ও গবেষকেরা।

বাংলাদেশের এসব আয়োজনে আরও যোগ দেন জাতিসংঘ সদর দপ্তর, জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র, থিংক ট্যাংক, নীতিনির্ধারক, বিষয়বিশেষজ্ঞ, গবেষকসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং স্বল্পোন্নত, ভূবেষ্টিত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি ফেকিতামোইলোয়া কাতোয়া ইউতোইকামানু, ভুটানের অর্থমন্ত্রী নামগে দরজি, জাতিসংঘে নিযুক্ত মালদ্বীপের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত আলী নাসির মোহামেদ ও ক্যাবো ভারদের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত জোসে লুইস ফিয়ালহো রোচা , ইউএনডিপির এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ও জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হাওলিয়াং ঝু, জাতিসংঘের এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কমিশনের (ইউএন-এসকাপ) উপনির্বাহী সচিব কাভে জাহেদি, জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) প্রধান রোনাল্ড মল্লিরুস্, ইউএন-ওএইচআরএলএলএসের পরিচালক হেইদি ফক্স, জাতিসংঘের ইনস্টিটিউট ফর ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চের নির্বাহী সম্পাদক নিখিল শেঠ, জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সমাজবিষয়ক বিভাগের পরিচালক স্টেফান স্কিউইনফেস্ট, নরওয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা লাইভ মারগ্রেথ রগনিরুড এবং বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ওমর সিরাজউদ্দিন।