আমেরিকাকে হটিয়ে পরাশক্তি হতে চায় চীন: সিআইএ

চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (রয়টার্সের ফাইল ছবি)
চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (রয়টার্সের ফাইল ছবি)

বিশ্বব্যাপী প্রভাব বাড়াতে চাইছে চীন। মূল লক্ষ্য পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়া। আর এটা করতে আমেরিকাকে সরিয়ে সেই জায়গা দখল করতে চাইছে চীন।

আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) কর্মকর্তা মাইকেল কলিনস এমনটাই মন্তব্য করেছেন। ২০ জুলাই আসপেন নিরাপত্তা ফোরামে দেওয়া বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।

আমেরিকার কলোরাডোয় ১৮-২১ জুলাই বসেছিল আসপেন নিরাপত্তা ফোরাম। এতে ‘চীনের উত্থান’ শীর্ষক এক সেশনে বক্তব্য দেন সিআইএর পূর্ব এশিয়া মিশনের সহকারী পরিচালক মাইকেল কলিনস। এতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে চীন-আমেরিকার সঙ্গে ‘স্নায়ু যুদ্ধে’ অবতীর্ণ হতে চাইছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ফোরামে কলিনস বলেন, ‘তারা যা করছে, আর প্রেসিডেন্ট শি যা বলছেন, তাতে আমি বলব আমাদের সঙ্গে মূলগতভাবে স্নায়ু যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চাইছে। এই স্নায়ু যুদ্ধ আগের স্নায়ু যুদ্ধের মতো নয়। এটি বাস্তবিকই স্নায়ু যুদ্ধ। একটি দেশ বৈধ-অবৈধ সব পন্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। লাভের জন্য সরকারি-বেসরকারি, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির ব্যবহার করছে শুধু প্রতিপক্ষের ভিত টলিয়ে দিতে, সরাসরি কোনো সংঘাতে অবতীর্ণ হওয়া ছাড়াই। চীনারা কোনো সংঘাত চায় না।’ কিন্তু দিন শেষে যখন কোনো স্বার্থ বা নীতি সম্পর্কিত বিষয় আসে, তারা চায় প্রতিটি দেশ আমেরিকা নয়, শুধু চীনের পাশেই থাকুক। চীনারা (বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে) আমেরিকার সঙ্গে ক্রমাগত সংঘাত তৈরি করছে। আর আমরা একে পদ্ধতিগত সংঘাত হিসেবে বিবেচনা করে চুপ করে আছি।’

ফোরামের তৃতীয় দিন দেওয়া বক্তব্যে কলিনস চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংয়ের দর্শন তুলে ধরেন। শি চিন পিংয়ের বিশ্ব-ভাবনা সম্প্রতি চীনের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া চীনা প্রেসিডেন্টের ওই লেখার উল্লেখ করে কলিনস বলেন, চীনের দিক থেকে আসা হুমকিই এখন আমেরিকার সামনে থাকা সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। তারা আমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর আমরা রাশিয়াকেই এখনো বড় হুমকি মনে করছি।’

সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফোরামে অংশ নেওয়া মার্কিন প্রশাসনের অন্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের দেওয়া বক্তব্যের সুরেই কথা বলেছেন মাইকেল কলিনস। ফোরামে যোগ দেওয়া এফবিআই পরিচালক ক্রিস্টোফার রে ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিচালক ড্যান কোটসও চীনকেই বর্তমানে আমেরিকার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে উল্লেখ করেছেন।

ফোরামের শুরুর দিন দেওয়া বক্তব্যে ক্রিস্টোফার রে বলেন, ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দৃষ্টিকোণ থেকে আমার মনে হয়, দেশ হিসেবে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড়, বিস্তৃত ও উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জটি আসছে চীনের দিক থেকে। আর এটি সর্বতোভাবে করছে তারা। প্রচলিত গুপ্তচরবৃত্তির পাশাপাশি তারা অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তিও করছে। প্রচলিত গোয়েন্দা কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে তারা অপ্রচলিত বিভিন্ন পন্থাও অবলম্বন করছে। এই কাছে মানুষের পাশাপাশি সাইবার পদ্ধতিও ব্যবহার কার হচ্ছে।’

ড্যান কোটস বলেন, ‘চীন সত্যিই বৈরী প্রতিপক্ষ নাকি আইনসম্মত প্রতিযোগী, সে বিষয়ে আমেরিকার উচিত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া।’ তিনি এ সময় চীনের ব্যবসায়িক গোপন তথ্য থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন গবেষণা চুরির চেষ্টার তীব্র সমালোচনা করেন। বলেন, ‘ঠিক এই জায়গা থেকেই আমাদের ভাবা উচিত।’

চীনের শাসকদের আমেরিকাবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক আন্ডারসেক্রেটারি মার্সেল লেটার সিএনএনকে বলেন, ‘কমিউনিস্ট পার্টির শাসনাধীন এই দেশ নিজ অঞ্চল ও এর বাইরের বিভিন্ন দেশে নিজেদের প্রভাববলয় প্রতিষ্ঠা করতে আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশল ব্যবহার করছে। এগুলোই হচ্ছে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে চীনের গৃহীত বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রধান হাতিয়ার।’

চীনের সামরিক শক্তির বিষয়ে মার্সেল বলেন, ‘বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক বাজেট চীনের। দেশটির রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম সেনাবাহিনী, তৃতীয় বৃহত্তম বিমানবাহিনী এবং ৩০০টি রণতরী ও ৬০টিরও বেশি সাবমেরিনে সজ্জিত শক্তিশালী নৌবাহিনী। এই সবকিছুই এখন হালনাগাদ ও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। আমেরিকায় গত এক-দুই দশকে আমরা আমাদের সমরশক্তিকে যেভাবে নবায়ন করেছি, তার দিকে লক্ষ্য রেখেই এই হালনাগাদ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মে মাসেই চীন নিজেদের তৈরি ৫০ হাজার টন ধারণক্ষমতার যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজ উদ্বোধন করেছে। গত ১২ এপ্রিল এই জাহাজ পরীক্ষামূলকভাবে সাগরে চলাচল করে। সেই সময় প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং কমিউনিস্ট পার্টির অধীনেই চীনের নৌবাহিনীকে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। একই সময়ে ভারত মহাসাগরে চীন একাধিক সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করেছে, যা এখন জিবুতি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সেখানে চীন দুটি রণতরী মোতায়েন করেছে, যাতে অবস্থানরত সেনাসংখ্যা অজ্ঞাত। এটিই নিজ সীমানার বাইরে চীনের প্রথম সামরিক ঘাঁটি। গত কয়েক বছরে দক্ষিণ চীন সাগরে চীন বেশ কিছু কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করেছে, যেখানে সামরিক ঘাঁটিও স্থাপন করেছে তারা। এই সব ঘাঁটিতে রাডার থেকে শুরু করে সব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।

দক্ষিণ চীন সাগরের অধিকাংশ অঞ্চলই নিজের বলে দাবি করে আসছে বেইজিং। যদিও এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকেরই সংশয় রয়েছে। এই অঞ্চলে মার্কিন সেনা উপস্থিতি এখন পর্যন্ত চীনকে কিছুটা লাগামের মধ্যে রেখেছে বলে মনে করেন পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুসান থরটন। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ চীন সাগরে আমেরিকার উপস্থিতি চীনকে তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। বড় প্রশ্ন হচ্ছে চীন কি নিয়মের মধ্য আসবে? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংগঠন আসিয়ানসহ সহযোগী বিভিন্ন দেশ ও আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সদস্যদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে বেইজিং? নাকি তারা একটি একটি সবাইকে পরাহত করে আরও বেশি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে?’

থরটন অবশ্য এরই মধ্যে তাঁর দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। গত জুনেই ট্রাম্প মনোনীত এই কর্মকর্তা পদত্যাগ পত্র জমা দেন। ২০ জুলাই ফোরামে বক্তব্য দেওয়ার শেষে তিনি জানান, এই প্যানেলের শেষেই তাঁর মেয়াদ শেষ হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমেরিকার কূটনৈতিক শক্তি চীনের চেয়ে এখনো বেশি। কিন্তু ৯/১১ ঘটনার পর থেকে আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের নজর ঘুরে যায় সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার দিকে। কিন্তু চীন এই সময়টাতে শুধু নিজের একক লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেছে। এ কারণেই আজকে আমেরিকার মতো পরাশক্তির সামনে চীন বড় মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। অবশ্য গত ডিসেম্বরে ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে চীনকে মোকাবিলাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একা নয়, বরং মিত্র দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বেইজিংকে মোকাবিলার কথা জানায় আমেরিকা।