গ্রিনকার্ডের আবেদন করে বিপদে পড়তে পারেন অভিবাসীরা

আমেরিকার অভিবাসনের কফিনে আরেকবার পেরেক ঠুকে দিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২২ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সরকারি সাহায্য–সহযোগিতা গ্রহণ করেন—এমন অভিবাসীদের গ্রিনকার্ড দেওয়া হবে না। ধারনা করা হচ্ছে, আমেরিকায় বসবাসরত বিদেশিদের জন্য নানা ধরণের সুবিধা বন্ধ কিংবা সুবিধাগ্রহণ আরও কঠোর করার জন্য এ ধরণের উদ্যোগ নিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন।
ফুড স্ট্যাম্প বা খাদ্য, চিকিৎসা, ওষুধপত্র বা সরকারি আবাসন সুবিধা নেওয়া অভিবাসীদের নতুন এই অভিবাসন নীতির আওতায় আনা হয়েছে। এমনকি অভিবাসীদের ক্রেডিট স্কোরও পরখ করে দেখা হতে পারে। কংগ্রেসের কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই পুরোনো আইনের কড়াকড়ি আরোপ করে এমন অভিবাসনবিরোধী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের এ পদক্ষেপের ফলে বছরে প্রায় চার লাখ অভিবাসী বিপদে পড়তে পারেন।

ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের প্রস্তাবিত রেগুলেশন্সে অভিবাসন কর্মকর্তাদের ভিসা কিংবা অভিবাসীদের বসবাসের অনুমতি প্রত্যাখ্যানের ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আমেরিকায় অভিবাসীদের প্রমাণ করতে হবে, তারা নিজেরা আত্মনির্ভরশীল। তারা সরকারি সাহায্য গ্রহণ করছে কিনা, স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা নিচ্ছে কি না, শিশুদের জন্য খাদ্য সহযোগিতা গ্রহণ করছে কিনা—সবই যাচাই করা হবে। প্রয়োজনে অভিবাসীদের ক্রেডিট স্কোর খতিয়ে দেখা হবে।

অভিবাসীদের ক্রেডিট পরীক্ষার মাধ্যমে অভিবাসনের জন্য আবেদন জানানো ব্যক্তিটির লেনদেনের সব তথ্য জানা যাবে। কোথাও বিল বকেয়া আছে কি না, ব্যাংক বা ক্রেডিট কার্ডের ঋণ আছে কি না তাও জানা যাবে। আমেরিকায় অভিবাসনের জন্য এমন কঠিন অর্থনৈতিক পরীক্ষায় পড়তে হবে অভিবাসীদের—একথা অকল্পনীয় ছিল। মার্কিন অভিভাসন বিভাগ মনে করছে, কোন লোকের ক্রেডিট স্কোর প্রমাণ করে, সে অর্থনৈতিকভাবে কতটা শক্তিশালী। ক্রেডিট স্কোরের মাধ্যমে পরখ করা হবে, ইমিগ্রেন্টরা সরকারি সাহায্য ছাড়া আমেরিকায় থাকতে পারবে কি না।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের ক্রিস্টজেন নেইলসেন ২১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার এমন এক বিধিতে স্বাক্ষর করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমেরিকায় যারা অভিবাসনের আবেদন করবেন, তাদের আর্থিকভাবে নিজেদের সাহায্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে।’
ট্রাম্প প্রশাসনের এসব পদক্ষেপের ফলে বছরে প্রায় চার লাখ অভিবাসী বিপদে পড়তে পারেন। অভিবাসীদের এখন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাঁরা কি আমেরিকায় টিকে থাকার কষ্টকর সংগ্রাম করবেন নাকি বেঁচে থাকার জন্য সরকারি সাহায্য নেবেন? খাদ্য ছাড়াও যারা স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা গ্রহণ করে থাকেন, তাদের জন্যও ট্রাম্পের আমেরিকা এবার কঠিন হয়ে উঠবে।
আমেরিকার অভিবাসন আইনে ভিসা বা গ্রিনকার্ড আবেদনকারী জনভর্তুকির মুখোমুখি হবে কি না, তা বিবেচনায় দেওয়ার বিধান রয়েছে। অভিবাসীদের দেশ আমেরিকায় কখনো এ নিয়ে আলাদা কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অভিবাসীরা দুই দশক ধরে প্রয়োজনে সরকারি সাহায্য গ্রহণ করে আসছে। বিশেষ করে অদক্ষ অভিবাসী, অভিবাসী পরিবারগুলো শিশুদের জন্য ব্যাপকভাবে খাদ্য সহযোগিতা গ্রহণ করে আসছে। বয়স্ক ব্যক্তি বা শারীরিক সমস্যায় যারা আছে, তাদের অনেকেই সরকারি স্বাস্থ্যবিমা গ্রহণ করে আসছে। পাশাপাশি নতুন দেশে এসে নানা কারণে গৃহহীন হয়ে পড়ার উপক্রম হলে আবাসন সহযোগিতার দ্বারও খোলা ছিল অভিবাসীদের জন্য। সরকারের নতুন উদ্যোগের ফলে এসব সুবিধা গ্রহণকারী অভিবাসীরা এখন আতঙ্কে আছেন। আমেরিকার ব্যয়বহুল চিকিৎসা বিমা গ্রহণ করা অনেক অভিবাসী পরিবারের পক্ষেই সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই তারা সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা গ্রহণ করে থাকেন। এসব বৈধ অভিবাসীদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা সরকারি ভর্তুকির সাহায্য গ্রহণ করবেন নাকি আমেরিকার সোনার হরিণ গ্রিনকার্ড গ্রহণ করবেন। অভিবাসী গ্রুপগুলো মনে করছে, নতুন এই বিধি আরোপের ফলে কয়েক লাখ অভিবাসীকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন বলছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসন ব্যবস্থাকে কঠিন করার সবচেয়ে আগ্রাসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। প্রশাসন এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, যার ফলে এমনিতেই লোকজন আমেরিকায় অভিবাসী হওয়ার উৎসাহ হারাবে। অনেকেই বাধ্য হয়ে এই দেশ ছেড়ে চলে যাবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা ২২ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করেছেন, খাদ্য সহায়তা ও আবাসন বিভাগের সেকশন ৮ নামে পরিচিত সুবিধাগুলো আইনিভাবে ব্যবহার করলেও নতুন অভিবাসীদের গ্রিনকার্ড দেওয়া নাও হতে পারে।
পুরোনো অভিবাসীদের মধ্যে অনেকেই মেডিকেয়ার কর্মসূচির আওতায় কম দামের প্রেসক্রিপশন ওষুধ পান। এখন থেকে এমন জনপ্রিয় লাভজনক কর্মসূচির সুবিধা ভোগ করলে তা ‘পাবলিক চার্জ’ বা ‘জনভর্তুকি’ হিসাবে বিবেচিত হবে। অভিবাসন আইনজীবীরা মনে করছেন, এসব কড়াকড়ির কারণে অনেকেই নিতান্ত প্রয়োজন সত্ত্বেও এসব সুবিধা গ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন। আমেরিকার সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ভিন্নভাবে।
চলতি সপ্তাহে ফেডারেল রেজিস্ট্রিতে বিধিটি তালিকাভুক্ত করার ৬০ দিনের মধ্যে তা কার্যকর হবে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন। এসব বিধি কার্যকর করার জন্য কংগ্রেসের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই।
অভিবাসী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলো মনে করে, নতুন উদ্যোগের ফলে আমেরিকার অনগ্রসর অভিবাসীরা সরকারের সহায়তা কর্মসূচি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার শুরু করবে। খাদ্য, আবাসন ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা হারানোর ঝুঁকিতে এখন অভিবাসীরা। তারা ভয় পাচ্ছে, এসব সুবিধা গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে তাদের গ্রিনকার্ড দেওয়া হবে না এবং আমেরিকা থেকে তাঁদের বহিষ্কার করা হবে।
ন্যাশনাল ইমিগ্রেশন সেন্টার বা জাতীয় অভিবাসন কেন্দ্র এক বিবৃতিতে বলেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন একটি বিধ্বংসী নতুন প্রস্তাবিত আইন ঘোষণা করেছেন যা অগণিত অভিবাসী পরিবার ও তাঁদের দেশের সব সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
আমেরিকায় অনেক অভিবাসী আছেন যারা গ্রিনকার্ডের আবেদন করেছেন, নতুন প্রস্তাবিত নীতিতে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন তারাও।
ট্রাম্প প্রশাসনের এমন উদ্যোগের রাজনৈতিক চাল রয়েছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাত্র দুই মাস আগে অতি রক্ষণশীলদের উসকে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য । আমেরিকার রক্ষণশীলরা অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কট্টর সমর্থক। প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে নিজের দলের দখল অব্যাহত রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি।
ট্রাম্পের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় পরামর্শদাতা স্টিফেন মিলার দীর্ঘদিন থেকে বিশ্বাস করেন, অভিবাসীদের ওপর কঠিন হওয়াই রিপাবলিকান প্রার্থীদের জন্য বিজয়ের কৌশল। যদিও অভিবাসী প্রধান নগরীগুলোর চিত্র ভিন্ন । এসব অভিবাসন বিধি চালুর কারণে শুধু নিউইয়র্কেই ১০ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর ঢেউ মধ্যবর্তী নির্বাচনে পড়তে পারে। ডেমোক্র্যাটরা এই ইস্যুকে কতটা কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারে, তা নিয়ে সন্দিহান রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
প্রতি বছর আমেরিকায় বসবাসরত প্রায় ৩ লাখ ৮২ হাজারের বেশি ব্যক্তি স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পেয়ে থাকেন। আর নতুন এই নীতি তাদের ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে—এখন সেটিই দেখা বিষয়।