বেলিজের বাবুই তুমি!

যাচ্ছে সে চেনা পথে, অচেনা মানুষ দেখতে দেখতে। সেই চেনা ট্রেন, চেনা গন্তব্য বুকে নিয়ে। তবু মাঝে মাঝে সব এলোমেলো হয়ে যায়। জীবন তো, সব সময় কি হিসেব মেলে? না মেলে না, মনুষ্যজীবন তো! তাই কখনো কখনো ভুল হয়ে যায়। আজ যেমনটি ভুল হয়ে গেল সজলের ।
চলতে চলতে মনে হয়, এ সে কোথায় চলেছে? তবে কি ভুল পথে, ভুল গন্তব্যের দিকে এগোচ্ছে সজল? চেনা মানুষ, চেনা ট্রেন ক্রমেই অচেনা হতে থাকে সজলের কাছে। পাতাল ট্রেনের ভেতর-বাহির সবই যেন সমান। হয় গাঢ় অন্ধকার, না হয় হাই-ভোল্টেজের বাতি লাগিয়ে অন্ধকার সরানো। উল্টো পথে উল্টো রথে সজল ছুটে চলেছে কি না, এমনি বুঝতে বুঝতে আরও কিছুটা সময় পার হয়ে গেল।
যখন বুঝল যে এটি ভুল রাস্তা, ভুল ট্রেনে এ পথে কখনোই ঘরে ফেরা যাবে না; তখন নিজের বোকামির জন্য ভীষণ রাগ হচ্ছিল সজলের। তাড়াহুড়া করে ট্রেন ধরতে গিয়েই যত পথবিভ্রাট! এমনি ভাবতে গিয়েও মনটা পুরোপুরি সায় দিল না।
সজলের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ভুল কি শুধু তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই করেছ সজল? সজল মাথায় আঙুল দিয়ে চিরুনি করতে করতে খুব দ্রুত আরেকবার দেখতে থাকে ভুল জীবনের ক্ষতচিহ্নগুলি।
সজলের ট্রেন চলছে ভুল পথে। নিজের গতিসীমা আরও বাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত ছুটে চলেছে এক্সপ্রেস ট্রেন। ঘরফেরত মানুষগুলো চোখ বন্ধ করে ঝিমোচ্ছে। কেউবা ফেসবুক নিয়ে, কেউবা ইয়ারফোন লাগিয়ে মিউজিকের তালে তালে মাথা ঝোঁকাচ্ছে। একটু আগেও যে ট্রেন কামরাটি সজলের প্রিয় ছিল, নিজেরই বোকামির জন্য সেই ভালো লাগাটা উবে গেল মুহূর্তেই। নিজের ওপর রাগ নিয়ে বিড়বিড় করে সজল বলতে লাগল, এত বছর তুমি আমেরিকা চষে বেড়াচ্ছ, নিউইয়র্কের সব রাস্তা-ঘাট তোমার হাতের রেখার মতো অতি চেনা; তারপরেও সজল তুমিই কিনা ভুল করে বসলে! কিছুতেই নিজেকে সহজ করতে পারছে না সজল, নিজের ওপরে রাগটা ক্রমেই বাড়ছে যেন।
কেন যেন সজলের মায়ের কথা মনে হলো। মনে হলো বাবার কথা। মনে হলো, বাবার অজানা দেশে চলে যাওয়ার কথা। সেপ্টেম্বরের ত্রিশ তারিখে দু বছর হবে বাবার চলে যাওয়া, অথচ সজলের মনে হয়, যেন কয়েকটা যুগ বাবা নেই! নেই বাবার কণ্ঠস্বর!
প্রায় ত্রিশ বছর পার হতে চলেছে, সজল পরবাসে! বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজন কারও দেখা নেই! দেখা করার জন্য সজলের মনটা উতল হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে যেতে মন চায়। প্রচণ্ড সাধ হয়, কিন্তু সামর্থ্য কোথায়? প্রবাস জীবনের এ এক ভয়াবহ হাহাকার নিয়ে পথ চলে সজল।
বাবা চলে যাওয়ার পর মার শরীরটাও ভীষণ ভেঙে পড়েছে। হয়তো মার সঙ্গেও সজলের আর দেখা হবে না! মনে হতেই বুকের ভেতরে হু হু করে ওঠে। বাবা চলে যাওয়ার কয়েক দিন আগে ফোনে ভাঙা গলায় অস্পষ্ট স্বরে বলেছিলেন, ‘দুঃখ করো না বাবা, তোমার সঙ্গে আমার আবারও দেখা হবে! দেখা হবে সে কী আত্মপ্রত্যয় ছিল বাবার, সেই কণ্ঠস্বর আজও সজলের কানে বাজে। ভয়াবহ তীব্র যন্ত্রণায় হাহাকার করে ওঠে সজলের ভেতর-বাহির! কামরার এপাশ-ওপাশ কী যেন খোঁজে সজলের ভিজে যাওয়া চোখ।
মানুষ দেখতে দেখতে বুকের চিনচিনে ব্যথাটার কিছুটা উপশম হয়। ঘরমুখী মানুষগুলোর ক্লান্ত প্রশান্ত মুখচ্ছবি দেখতে দেখতে সজল আপনমনে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, কেউ ফেরে ঘরে, আর কেউ ঘর থেকে দূরে; ভুল পথে ভুল গন্তব্যে।
ব্রঙ্কসগামী ‘ডি’ এক্সপ্রেস ট্রেন ততক্ষণে ম্যানহাটন ছেড়ে ব্রঙ্কসের কাছাকাছি। সজলের ট্রেন থেকে কেন জানি নামতে ইচ্ছে হলো না। মনে হলো, উল্টো পথে, উল্টো রথে যাই না আরও কিছু দূর।
উদভ্রান্তের মতো এমনি ভাবতে ভাবতে অজানা এক স্টেশনে নেমে পড়ল সজল। প্ল্যাটফর্মে নেমে নাম খুঁজে দেখে ‘লংউড’। নাম দেখে সজলের হাসি পায়। মনে মনে বলে, উডহেভেনের মানুষ এখন পথ হারিয়ে লংউডে, আচ্ছা এখানেও ‘লংউড’ কেন? ‘লংট্রি’ হলে কি খুব ক্ষতি হতো?
লাভ-ক্ষতির হিসেবটা দূরে সরিয়ে সজল ছুটল প্ল্যাটফর্মের অপরদিকে, ফিরতি ট্রেনের আশায়। স্টেশনে গিজগিজ করছে মানুষ। এ সময়টা এমনই। কাজ শেষে ঘরে ফেরা মানুষের ঢল। মানুষগুলোর ওপরে আরও একবার চোখ বুলিয়ে নিল সজল। দেখতে গিয়ে আচমকা আটকে গেল সে। আটকে গেল সজলের দৃষ্টি পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা এক মেয়ের ওপরে।
ফরসা। হালকা-পাতলা গড়ন, পরনে স্কার্ট। গায়ে জড়ানো হালকা জ্যাকেট, কাঁধে ঝোলানো স্পোর্টস ব্যাগ। হালকা রং করা চুলগুলো রাবারব্যান্ড দিয়ে ওপরে টেনে বাঁধা। উন্নত গ্রীবা, খাড়া নাক। টানা টানা চোখের ভেতরে মিহি কালো অক্ষিতারা। ওষ্ঠে হালকা চেপস্টিক ছাড়া আর কোনো প্রসাধন নেই। অপরূপ মেয়েটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সজল বুঝতে চেষ্টা করল, কোনো দেশের পরি সে! কখনো সজলের মনে হয় স্প্যানিশ, আবার কখনো মনে হয় চায়নিজ অথবা কোরিয়ান ।
অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ে দেখে বরাবরের মতো হোঁচট খেল সজল। সজলের মনটা হঠাৎ এখন অন্যরকম রাজামন যেন। মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে সজল ভুলে গেল পথ হারানোর ব্যথা। আড়চোখে দেখতে গিয়ে আরও দু’বার চোখাচোখি হয়েছে সজলের। চোখে চোখ পড়তেই আবারও একটা শক্ত হোঁচট খেল সে।
আজ সজলের কী যে হলো!
ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে ভিড়তেই তাড়াতাড়ি সজল মেয়েটির সঙ্গে পাশাপাশি সিটে বসল। ট্রেনে-বাসে সজল কারও সঙ্গে তেমন কোনো কথা বলে না। কেউ কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে তবেই হয়তো দু একটা কথা বলে সে। কিন্তু আজ এ কী হলো সজলের। আরও একবার চোখে চোখ পড়ায় মেয়েটিই হেসে উঠল প্রথমে। সজলের রাজা মনটা হেসে উঠল সুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে সঙ্গে।
প্রায় ত্রিশ বছরের প্রবাস জীবনে অনেক সুন্দরী বিদেশিনী দেখেছে সজল। কিন্তু কারও চোখে এমন শান্ত নদী কখনো দেখেনি সে। তাঁর কবি মনটা সেই নদীতে সাঁতার কাটতে কাটতে, কবি গুরুর শেষের কবিতার ‘অমিত-লাবণ্য’ র কথা মনে হলো । মনে হলো কবির সেই বিখ্যাত অনুভূতিটা ‘‘পথ, আজ একি তুমি পাগলামি করলে .... ”
হ্যাঁ , পথ আজ পাগলামিই করল সজলের জীবনে।
পথ হারিয়েছে সজল। সে আজ পথ হারানো লাগামছাড়া মন নিয়ে এক বিদেশিনির পাশে বসে কবিতা লিখতে চায়। কী কবিতা লিখবে তাই ভাবছে সে। মুখে মিটিমিটি হাসি নিয়ে মেয়িটিই বা কী ভাবছে? সজল আজ কিছুটা ডেসপারেট। কথা বলার অদম্য বাসনায় বিভোর হয়ে বোকা বোকা মুখ নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল আবারও। মেয়েটির মুখে তখনো সেই মায়াবী হাসি লেগেই রয়েছে। নিউইয়র্কের এই ত্রিশ বছরের জীবনে অল্প কিছু ইংরেজি বলতে শিখেছে সজল। কিন্তু মায়ের ভাষায় কথা বলতেই সজল ভালোবাসে বেশি। একেবারে নিরুপায় না হলে সজল ইংরেজি বলতে চায় না। সেই অল্প ইংরেজির ওপরে ভর করে সজলই শুরু করল, আজ আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, আমি কুইন্সে যেতে চাই; কিন্তু ওই ‘ডি এক্সপ্রেস ট্রেন’টি আমাকে ব্রঙ্কসে নিয়ে যাচ্ছিল।
সজলের কথা শেষ না হতেই মেয়েটি খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। সজল অবাক হয়ে ওই হাসি মাখা বিদেশিনীর মুখের দিকে চেয়ে রইল। মেয়েটি তখনো হাসছে। সজলের মনে হলো যেন মেয়েটির সর্বাঙ্গ হাসিতে লুটোপুটি খাচ্ছে ।
মেয়েটি হাসতে হাসতে কী যেন খুঁজে ফিরছিলো সজলের চোখে । কী পেল, আর কিই বা বুঝল সেই বিদেশিনী জানে। সজলের সরলতা যে মেয়েটিকে ছুঁতে পেরেছে, সেটুকু বুঝতে সজলের কোনো অসুবিধা হলো না ।
গায়ে জড়ানো হালকা জ্যাকেটটি খুলতে খুলতে মেয়েটি জানতে চাইল, সজল কোনো ট্রেন খুঁজে পেতে চায়? এটুকু ইংরেজি শুনেই সজল বুঝল যে মেয়েটি অন্য কোনো ভাষার। খুব থেমে ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে বলতে মেয়েটি শরীরের জ্যাকেটটি ভাঁজ করে খুব যত্ন করে ব্যাগের ভেতরে রাখতে গেল। এরই ফাঁকে আরও ভালো করে মেয়েটিকে দেখে নিল সজল। হাঁটুর নিচু থেকে ফরসা পা, হাতের আঙুল, তাতে লাল রঙয়ের নেইলপলিশ, ঠোঁটে হালকা গ্লিসারিনের প্রলেপ, ভারী বুক—সব এক পলকে আরও একবার সজলের চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। বিদেশিনীর চোখের আলোও এসে ছুঁয়ে গেল সজলকে।
সজলের শরীরে সেই আলোর উত্তাপ লাগার চেয়ে, বিদেশিনীকে মায়াবী এক নদীর শান্ত ঢেউ মনে হলো সজলের। শরতের শান্ত সে নদীর জলে সাঁতার কাটতে চায় সজলের মন। কিছুক্ষণের জন্য কোথায় যেন হারিয়েছিল সজল। হঠাৎ সংবিৎ ফিরল মেয়েটির আবারও প্রশ্নে, কোনো ট্রেনে তুমি যেতে চাও তা তো বললে না?
সজল বলল, আমি কুইন্স গামী ‘ই’ অথবা ‘এফ’ ট্রেন ধরতে চাই, আমি জ্যাকসন হাইটসে যাব। মেয়েটির মুখে সেই মনোমুগ্ধকর হাসি তখনো লেগে আছে। হাসতে হাসতে মেয়েটি সজলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কোনো চিন্তা করো না, ওই একই ট্রেন আমিও ধরব; তবে আমি কুইন্সে যাব না। মাঝপথে আমি নেমে যাব, ভয় নেই, আমি তোমাকে তোমার পথ দেখিয়ে তবেই নামব; বলে মেয়েটি আবারও হাসতে লাগল। হাসিতে যেন মুক্তো ঝরে পড়ে। সজলের মনে হয় এই বিদেশিনী যেন তার কত দিনের চেনা!
তারপর আর কারও জন্য কোনো আড়ষ্টতায় পড়তে হয়নি, করতে হয়নি অপেক্ষা কারও কথা খুঁজে পেতে। মনে হয় যেন ওরা কত দিনের চেনা জানা স্বজন ।
দীর্ঘদিনের খুব চেনা বন্ধুর মতো কথা বলছিল ওরা। মেয়েটির ভাষা জড়তা থাকায় সজলই বেশি কথা বলছিল, আর জানতে চেয়েছিল কত আপনা কথা!
মেয়েটি একটু থেমে থেমে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কখনো বা কথার মাঝপথে থেমে গিয়ে মেয়েটি শুধু জাদুমাখা হাসি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল কথার বাকিটা।
কোনো দিন কোনো মানুষ নিয়ে সজল এত কৌতূহল দেখায়নি, কিন্তু আজ কী যে হলো। সজলের খুব ইচ্ছে হলো মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে। বন্ধুত্ব করতে।
সজল মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি কাজ শেষে ঘরে ফিরছ?’
মেয়েটি মাথা নেড়ে জানাল, ‘না’ ।
তাহলে?
মেয়েটি উত্তরে জানাল, আমি জিমে যাচ্ছি, সুইমিং শিখতে ।
এমনতর জবাবের জন্য সজল একদম প্রস্তুত ছিল না। কি বলবে সে আর ভেবে পায় না। মেয়েটিই আবার নীরবতা ভেঙে বলতে লাগল, সুইমিং আমার খুব প্রিয়, আমি সুইমিং ভালোবাসি।
সুইমিংয়ে আজ আমার প্রথম দিন, আমি সুইমিং জানি না; তাই আমি ভীষণ নার্ভাস।
সজল মন্ত্রমুগ্ধের মতো মেয়েটির চাঁদ মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিল। ট্রেনের কামরায় ভর্তি মানুষ, সেদিকে ওদের কারওরই ছিল না খেয়াল। সজল যতই দেখে, ততই মুগ্ধ হতে থাকে। তখনো সজল জানতে পারেনি, কোনো দেশের রানি সে!
তাই সজল মেয়েটির চোখের তারায় আলো ফেলে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কি খুব জল পছন্দ করো? নদী? কিংবা সমুদ্র ?
প্রশ্ন শুনে মুহূর্তেই সেদিন মেয়েটি জলপদ্ম হয়ে ফুটে উঠেছিল ।
জলপরি, না তোমাকে দেখে মনে হয়, তুমি অনেক দেশের মতো। খুশিতে মেয়েটি হাত পা নেচে বলল, ‘তাই! মন নাচাতে নাচাতে মেয়েটি বলল, ‘জানি তুমি পারবে না বলতে, বলেই আবার সেই হাসি! সেই চাহনি!’
হাসতে হাসতে একটু কাছে সরে সজলের চোখে চোখ রেখে একটু গাঢ় স্বরে মেয়েটি বলল, ‘আমি বেলিজ-এর মেয়ে!’
সজল নাম শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে মেয়েটির দিকে তাকয়ে রইল। মেয়েটিও কোনো জড়তা না রেখে সরাসরি সজলের কাছে জানতে চাইল, তুমি কি শুনেছ কখনো আমার এ দেশের নাম?
সজল আমতা-আমতা করে আবারও জানতে চাইল, কী যেন নাম ?
মেয়েটি হাসতে হাসতে বানান করে উচ্চারণ করল, ‘B-E-L-I-Z-E’ ( বে-লি-জ)।
দেশের নাম শুনে সজল মাথা নাড়ল, না, এই নাম আমি আগে কখনোই শুনিনি, আজই জানলাম; তুমি জানালে। তুমি শোনালে।
মেয়েটি খুব সহজ করে নিয়ে বলল, তাতে দোষের কিছু নেই, আমরা এখনো অনেক কিছুই জানি না, বলেই মেয়েটি একটু কাছাকাছি এসে আপন জনের মতো খুব সিরিয়াস হয়ে অতীব আগ্রহ নিয়ে নিজের দেশের কথা বলতে শুরু করল। নিজের দেশ নিয়ে অনর্গল বলে চলেছে এক বিদেশিনী, অন্য এক ভিনদেশি মানুষের কাছে। প্রবাসে এলেই মানুষ দেশকে খুব মিস করে, দেশের প্রতি ভালোবাসা আরও সুগভীর হয়, সেটি আবারও প্রমাণিত হলো সজলের কাছে। মেয়েটি তখনো বলে চলেছে, ‘বেলিজ’ সেন্ট্রাল আমেরিকার খুবই ছোট্ট একটি দেশ।
ছোট, কিন্তু দারুণ সুন্দর। বেলিজের পূর্ব দিকে ক্যারিবিয়ান সি, সত্যিই অপূর্ব! আর পশ্চিমের দিকে গভীর বনাঞ্চল, সত্যি দৃষ্টিনন্দন! দুটোই আমার কাছে ভীষণ প্রিয়।
সজল হাঁ করে গিলছে সেই জলপদ্ম বিদেশিনীর মুখের কথা। সজলের এভাবে চেয়ে থাকার মানে বুঝতে পেরে, সেই ধবধবে ফরসা বিদেশিনীর মুখটি লাল আভায় রাঙা হলো মুহূর্তেই। সেই এক আলো ভরা মুখশ্রী, সেই এক যৌবনের লুকোচুরি যেন।
মেয়েটির মুখের কথা যেন ফল্গুধারা। মেয়েটি আবারও সজলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আমার ক্যারিবিয়ান সিতে সাঁতার কাটতে চাই। এ সামারে আমি সাঁতার কাটতে পারিনি, সে জন্য ভীষণ মন খারাপ আমার। তাই মন লো করার জন্য সাঁতার শিখতে যাচ্ছি।
তন্ময় হয়ে কথা শুনছে সজল। নদী-জল-সমুদ্রের কথা বলতে বলতে মেয়েটিকে মনে হচ্ছে, যেন ক্যারিবিয়ান সি’র জলছায়া জলপরি ।
ট্রেন চলছে। এরই মাঝে ‘এ’ ট্রেন বদল করে ওরা কুইন্সগামী ‘ই’ ট্রেনে গিয়েছে। ‘ই’ট্রেনে উঠে ওরা আবারও পাশাপাশি বসল। সজলের পাশে বসতে বসতে মেয়েটি সজলকে জিজ্ঞেস করল, তুমি সাঁতার জানো?
সজল বলল, হ্যাঁ, সেই ছোটবেলা থেকে।
মেয়েটি সজলের কাছে ওর দেশের নাম জানতে চাইলে, সে যেন মুহূর্তেই অন্যরকম হয়ে গেল। আজ বেলিজের এই মেয়েটিকে সজল তার প্রিয় দেশের কথা, ছোটবেলার সেই আত্রাই নদীর কথা, ভাষার কথা, সমুদ্রসৈকতের কথা বলতে বলতে ওরা কখন যেন বন্ধু হয়ে গেল। তখনো মেয়েটি সজলের মুখের দিকে তাকিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে কথা শুনছে। কথা বলতে বলতে সজলের মনে হলো, পাশে বসা ক্ষণিক আগে দেখা এই মেয়েটি ওর কত দিনের চেনা। আজ ওদের ভালো লাগা নিয়ে ওরা নিজেরাই ছুটে চলেছে জীবনের কিছুটা পথ। জীবনের এই মোহনায় আজ সোনালি এক জীবন যেন ওদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।
ট্রেন চলছে। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে দুলছে বিদেশিনী। সজল তখনো সাঁতার নিয়ে কথা বলে চলেছে। মেয়েটি কথার মাঝে হঠাৎ সজলকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, আমি তো তাহলে তোমার কাছেই সাঁতার শিখতে পারি, তুমিই তো আমার ট্রেনিং মাস্টার হতে পারো; পারো না?
মেয়েটির চোখে মুখে এক দুষ্টুমিপূর্ণ হাসি মুহূর্তেই ঝিলিক দিয়ে গেল। ওদের দু’জনের হাসিতে মনে হয় কেঁপে উঠল পুরো দুনিয়াটা। সজলের মনে হলো কত দিন সে এভাবে হাসেনি। সজল ভুলে গেল যে, সে পথ হারিয়েছে একটু আগে। কথায় কথায় ওরা কতটা পথ যে চলে এসেছে তা সজলের খেয়াল নেই। খেয়াল হলো তখন, যখন ট্রেন থামতেই হঠাৎ মেয়েটি বলে উঠল, আমি এখানে নামব, বলেই ট্রেনের দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই মেয়েটি দ্রুত নেমে পড়ল।
মুহূর্তেই চুপসে গেল সজল। ট্রেনের কামরার আলোগুলো মনে হয় দপ করে গেল নিভে। ট্রেনের এয়ারকন্ডিশনারও গেছে থেমে এমনি মনে হলো সজলের।
ঘেমে যাচ্ছে সজল। মেয়েটির নাম-নম্বর যে জানা হয়নি!
সে কি নাম ফোন নম্বর জানতে ফিরে যাবে মেয়েটির নেমে যাওয়া স্টেশনে! সত্য সত্য সজলের রাগ হলো নিজের ওপরে এখন। এত রাগ বোধ হয় হয়নি কখনো। নিজের মাথার চুলগুলো ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে এখন।
ততক্ষণে কুইন্সগামী ‘ই এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি পাতাল দিয়ে পার হচ্ছে ইস্ট রিভারের সীমানা। চোখ বন্ধ করে ভাবছে নিজের বোকামির কথা। তার কষ্ট নিয়ে একদিকে ছুটে চলেছে পাতাল ট্রেন, অন্যদিকে সে দেখছে নদীর উথাল-পাতাল ঢেউয়ের তালে তালে সাঁতার কাটছে তার বেলিজের জলপরি। সজলের মন তাতে সাঁতার কাটতে থাকে সারা বেলা! বেলাশেষে তখনো বিদেশিনীর সেই হাসি প্রাণে বাজে তার। জলপরির সেই জল কাঁপানো হাসিতে, তার হৃদয় ওঠে নেচে। ইস্ট রিভারের জলে তখনো সাঁতার কাটে বিদেশিনী আর সে! সাঁতার কাটতে কাটতে জলপরিকে সজল বলে, বেলিজের বাবুই তুমি!