কোরীয় যুদ্ধ সন্তান

সাবওয়েতে যাওয়ার পথে প্রতিদিন চোখে পড়ত ষাটোর্ধ্ব এক পুরুষকে। দাঁড়িয়ে থাকতেন বাড়ির বাইরে, সঙ্গের নারী থাকতেন বারান্দায়। বাড়ির সামনে নানা ধরনের ফুলের টব। টবগুলো নতুন রঙের প্রলেপে ঝক ঝক করছে। বারান্দার গ্রিলে গাঢ় ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে বেগুনি রঙের ছোট ছোট ঝুলন্ত ফুল। দুজনের দিকে তাকালেই মৃদু একটি হাসি ছিল প্রতিদিনের রুটিন কাজ। কয়দিন আগে হঠাৎ দেখি চিলতে বাগানের বামপাশে রাখা ৩/৪টি বড় সাইজের সিরামিকের টবে থোকা থোকা মরিচ। তা আবার বেশ বড় আকারের। রংবেরঙের ফুলের রাজ্যে পরিচিত মরিচের আকার আর গাঢ় সবুজ আমাকে থামিয়ে দিল। আমার আগ্রহ যে আরও দুজন খেয়াল করছেন, তা ছিল আমার অজানা। হ্যালো, শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি বাড়ির কর্তা ইশারায় আমাকে ডাকছেন। গেটের ওপাশে দাঁড়াতেই ভেতরের দিক থেকে আস্তে করে ফটক খুলে ভেতরে যেতে বললেন।
ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই চোখে পড়ল নানা রং আর বিভিন্ন আকারের ফুলের টবে পুরো বারান্দা ভর্তি। দু চারটি ক্যাকটাসও চোখে পড়ল। বাগানের এক পাশে দুটি ইজি চেয়ারের একটিতে আসন নিলাম আমি। বসার সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার শুদ্ধ ইংরেজিতে জানতে চাইলেন, পানীয় কী নেব! ঠান্ডা না গরম? উত্তরে কোনো কিছু নেব না শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন দুজন। খানিক নীরবতার পর বয়স্ক পুরুষ লোকটি সরাসরি জানতে চাইলেন, তাঁর ফুল এবং সবজির বাগান আমার কাছে এত প্রিয় কেন? দুজন নাকি পুরো গ্রীষ্মজুড়ে খেয়াল করেছেন, আমি প্রতিদিন তাঁদের বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখি, যা তাঁদের দুজনকে অনেক আনন্দ দেয়। পরের প্রশ্ন আরও মজার। তুমি কী ভালোবাস? ফুল না সবজি? আমি বললাম, দুটোই আমার প্রিয়। তবে এর চেয়ে আমার বেশি প্রিয় তোমরা যেভাবে যত্ন করে এই বাগানটি দেখাশোনা করছ সেটি। এটা শুধু আমার প্রিয়ই নয়, এক বিস্ময়ও বটে! তাই নাকি—বলেই দুজনের আনন্দমিশ্রিত হাসি, বেশ ছোট করে। এভাবেই শুরু। চলে আসব বলে দাঁড়ালে পুরুষ লোকটি বললেন, বাগান থেকে তোমার পছন্দের কিছু একটা নিয়ে যাও। বাগানের বাম পাশের টবে রাখা সবুজ মরিচগুলো দেখিয়ে বললাম, ওখান থেকে দু চারটি দিতে পারো। মরিচের আবদার শুনে ছোট ছোট চোখ কপালে তুলে ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, জান তো ওই মরিচগুলো কিন্তু অনেক হট! উত্তরে বললাম, আমি তা জানি এবং খেতেও ভালোবাসি। শুনে হো হো করে আবার সরল অভিব্যক্তির হাসি দিয়ে এগিয়ে এসে গাছ থেকে ৬/৭টি মরিচ পেড়ে হাতে দিলেন। উপহারের মরিচ হাতে নিয়ে জেনে নিলাম তাঁর নাম ইয়ং সান পার্ক। বর্তমান নিবাস আমেরিকা হলেও উনি কোরীয়। জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ায়। পরে অভিবাসীর মর্যাদায় এখন আমেরিকান।
বাঙালি রসনায় কাঁচা মরিচের কোনো বিকল্প নেই বলে সবার ধারণা। কোনো বাঙালি পঞ্চব্যঞ্জন নিয়ে খেতে বসবেন আর পাতে কাঁচা মরিচ থাকবে না, তা কি হয়! আমি একজন খাদ্য রসিককে জানি, যিনি রাত কিংবা দুপুরের খাবার কিংবা বৈকালিক জল খাবার যাই খেতে বসেন না কেন, পাতের পাশে গোটা দশেক কাঁচা মরিচ থাকতেই হবে। তাঁর কাঁচা মরিচের এ রাজসিক উপস্থিতি দেখে আমাকে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন, উনি কি নাশতা পানি কিছু খান? নাকি শুধু কাঁচা মরিচ দিয়ে খাবারের পাট চুকিয়ে দেন। জবাবে বলেছিলাম, কটি দিন সঙ্গে থাকুন উত্তর পেয়ে যাবেন। পরদিন সাবওয়েতে যাওয়ার সময় দুজনের কাউকেই চোখে পড়ল না। আরও দুদিন পর আমার প্রতিদিনের চেনা পথে বেরিয়েছি। মোড় ঘুরেই পার্কের বাসা। দেখা হয়ে গেল সেই চিরপরিচিত হাসির সঙ্গে; আর অবস্থানও আগের জায়গাতেই। তবে বারান্দায় আজ অন্যজন নেই। মরিচ নিয়ে আসার দিন থেকে যখনই পার্কের কথা মনে পড়ে, তখনই ভাবি দক্ষিণ কোরীয় পার্কেরও জীবনে হয়তো অভিবাসনের একটা গল্প আছে। এ দেশে একেবারে চলে আসা সব বিদেশির বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্পের বোধকরি শেষ নেই। সেখানে পার্কদের কাহিনি হয়তোবা হতে পারে আরও চমকপ্রদ।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, প্রতিবেশী সবুজপ্রিয় কোরীয় পার্কের এ দেশে আসবার গল্প শুনব। হাসির জবাব দিতে কাছে যেতে না যেতেই জিজ্ঞেস করলেন, হাঁটতে বেরিয়েছ না কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে? উত্তরে বললাম, আসলে দুটোর কোনোটাই নয় বরং তোমার অসুবিধা না হলে তোমার সঙ্গে বসে গল্প করতে করতে সময় কাটাতে চাই। ছোট শিশুর মতো লাফিয়ে উঠে বলল, কী সৌভাগ্য আমার! তুমি বসতে চাও আমার সঙ্গে গল্প করতে? এসো এসো বাড়ির ভেতরে এসো। কী সৌভাগ্য আমার, কী সৌভাগ্য!!
ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বললাম, পার্ক তোমার এই সুন্দর বাগানে কি দুজনে বসতে পারি? উত্তরে পার্ক বলল, কেন নয়? তুমি যখন চাইছ তা হলে বাগানেই বসি।
আমি বসতে না বসতেই পার্ক লাপাত্তা। বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এল সাজানো নীল রঙের কেটলি আর তার সঙ্গে ছোট ছোট দুটো চায়ের কাপ নিয়ে। চারদিকে বিশেষ এক ধরনের চায়ের সুবাস ছড়িয়ে দিয়ে পার্ক দুটো ছোট্ট কাপে ঢেলে দিলেন লালচে রঙের চা। বাহ, চায়ের সরঞ্জাম দেখে আর তার সুবাসে মন ভরে গেল। তারপর কখন যে গল্প শুরু হলো, তার সময়-ক্ষণ আমার মনে নেই! তবে সেই অজানা অচেনা অভিবাসীর গল্প আমাকে যে বেশ কিছুদিন এলোমেলো করে রেখেছিল সে কথা বলতে পারি।
পার্ক একজন যুদ্ধ সন্তান। যে নারী তাঁর সঙ্গে আছেন তিনিও! ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৩ সালে সংঘটিত দুই কোরিয়ার যুদ্ধের ফসল পার্ক ও তাঁর সঙ্গী। পার্কের মা সিউলের এক রেস্তোরাঁয় বার টেন্ডার ছিলেন, যেখানে আমেরিকান সেনারা যেতো ফুর্তি আর মদ্য পান করতে। দুই কোরিয়ার মধ্যে চলা যুদ্ধে দুই পরাশক্তির অনুপ্রবেশ ঘটে। উত্তর কোরিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন আর দক্ষিণে আমেরিকা। পার্কের বাবা জেমস যাকে সবাই ‘জিমি’ বলে ডাকত—ছিলেন অ্যারিজোনার অধিবাসী। যুদ্ধ শুরুর পরের বছর তিনি যোগ দেন সীমান্তে যুদ্ধরত আমেরিকান সৈন্যদের সঙ্গে। আহত হয়ে ছয় মাস পর ফিরে আসেন রাজধানী সিউলের উপকণ্ঠের আমেরিকান ঘাঁটিতে। প্রায় তিন মাস পর সুস্থ হলে একদিন আসেন এই রেস্তোরাঁয়। প্রথম দেখাতেই সুন্দরী কোরীয় বার টেন্ডার পার্কের মার প্রেমে পড়ে যান। দুজনে একসঙ্গে আরও তিন মাস সময় কাটান সিউলের উপকণ্ঠে পার্কের মায়ের ভাড়া অ্যাপার্টমেন্টে। আমেরিকান জেমস যুদ্ধে ফেরত যাওয়ার পর মা টের পান, তাঁর গর্ভে সন্তান। মা টেলিগ্রাম করে জেমসকে তাঁর গর্ভের সন্তানের খবর জানান। কোনো উত্তর আসে না। গর্ভাবস্থায় একদিন মার্কিন ঘাঁটিতে গিয়ে জেমসের খবর নিতে চান। কর্তৃপক্ষ পার্কের মাকে জেমসের কোনো খবর দিতে পারেনি। তবে জেমসের ব্যক্তিগত কিছু তথ্যাদি তাঁরা পার্কের মায়ের হাতে তুলে দেন।
তারপর একে একে ষোলোটি বছর চলে যাওয়ার পর আমেরিকা সম্মত হলো, কোরীয় সব যুদ্ধ সন্তানকে ফেরত নেবে তারা। মা ও ছেলে পার্ক অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মায়ের কাছে থাকা জেমসের সামরিক তথ্যের সূত্র ধরে শুধু পার্ক পেল আমেরিকায় আসার অধিকার। অধিকাংশ যুদ্ধ সন্তান এসেছিল সান ফ্রানসিসকোতে। শুরু হলো পার্কের আমেরিকান জীবন। শর্ত ছিল, সন্তান যখন পরিবার পালনে সক্ষম হবে তখনই নিজ মাকে আমেরিকায় আনতে পারবে। চার বছরের মধ্যে পার্ক তাঁর মাকে আনার উপযুক্ত হলেন। যুদ্ধ সন্তানদের দেখভাল করত যে অফিস, পার্কের মায়ের সব কাগজ অফিস তৈরি করল বটে। কিন্তু সে সব দলিল কাজে লাগানোর আগেই পার্কের মা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। পার্কের আর কোনো পিছুটান রইল না। তবে মনের কোণে সব সময় স্বপ্ন দেখতেন, একদিন হয় তো তিনি তাঁর জন্মদাতার সঙ্গে মিলিত হবেন।
বছর পাঁচেক পর চলে এলেন রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে। নির্মাণ কোম্পানিতে কাজ করে বেশ ভালো উপার্জন করলেন পার্ক। তবে কোরীয় সমাজ তাকে গ্রহণ করল না। ইচ্ছে ছিল, দেশি কাউকে বিয়ে করে সংসার গড়বেন, তা আর হল না। আমেরিকায় আসার ১০ বছর পর ফেডারেল থেকে সরকারের স্বীকৃতির চিঠি পেলেন। সরকার সব যুদ্ধ সন্তানকে ডিএনএ টেস্ট করে জন্মসনদ দেবে। গ্রীষ্মের রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক দিনে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে পেন্টাগন ভবনের বিরাট হলে আয়োজন করা হলো যুদ্ধ সন্তানদের জন্মসনদ দেওয়ার অনুষ্ঠান। ঘোষক প্রথমে বাবার নামের আদ্যাক্ষর অনুসারে পুরো নাম ও পদবিসহ যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত তথ্য দিয়ে সরকারস্বীকৃত ঔরসজাত সন্তানদের নাম ডেকে যাচ্ছেন আর নানা নির্দেশিকা অনুসরণের কথা বলছেন। প্রায় দুই ঘণ্টা পর পার্ক শুনতে পেলেন তাঁর আকাঙ্ক্ষিত নাম জেমস উইলিয়াম, সঙ্গে পদবি, ব্যাচ নম্বর, যুদ্ধ সাল ও আমেরিকার মূল বসতির বিস্তারিত—যা ৪০ বছর ধরে পার্ক সযত্নে বয়ে বেড়াচ্ছেন। ধীরে ধীরে পার্ক যখন মঞ্চের দিকে যাচ্ছে হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করলেন, আরও একজন তারই সঙ্গে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলছেন তাঁরই পাশাপাশি। মঞ্চের দু-পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠে দুজনই গ্রহণ করলেন নিজ নিজ জন্মসনদ, যার মধ্যে লেখা আছে পিতা: জেমস উইলিয়াম, তবে মায়ের নাম ভিন্ন। ক্ষণিকের দৃষ্টিবিনিময়ে তাদের দুজনেরই মনে হলো, তাদের শরীরে বইছে অ্যারিজোনার একই আমেরিকান সৈনিকের রক্ত।
হাজারো দুঃখ আর কষ্টের স্মৃতি নিয়ে বয়ে যাওয়া কোরীয় যুদ্ধের ফসল যুদ্ধ সন্তানের স্বীকৃতি নিতে এসে মিলন হলো একই পিতার ঔরসে জন্ম নেওয়া ভাই আর বোনের। পার্কের মুখে গল্প শুনে আমি আর বাস্তবে ছিলাম না। সংবিৎ ফিরলে পার্ককে জিজ্ঞেস করলাম, প্রতিদিন যাঁকে বারান্দায় দেখি তিনি কি তোমার বোন? উত্তরে আমেরিকান এক সৈনিকের সন্তান ইয়ং সান পার্ক বললেন, হ্যাঁ, তিনি আমার বোন। তাঁর নাম সি ইউন। ওই যে দেখ, সে ফিরে এসেছে। নিশ্চয় সে আজও তোমাকে তোমার প্রিয় কিছু হট মরিচ উপহার দেবে। বলেই খুক খুক করে হাসতে লাগল পার্ক!