উদীচীর সুবর্ণজয়ন্তী ও আগামী দিনের অঙ্গীকার

উদীচীর সুবর্ণজয়ন্তী
উদীচীর সুবর্ণজয়ন্তী

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর এবার ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। নিউইয়র্ক উদীচীর ২০তম বর্ষপূর্তি। দেশে–বিদেশে বিরাট আয়োজনে সংগঠনের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই নিউইয়র্ক উদীচী ২০তম বর্ষপূর্তির সঙ্গে আড়াম্বরে ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে ২০ ও ২১ অক্টোবর।
একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের দীর্ঘ ৫০ বছর অতিক্রম করা চাট্টিখানি কথা নয়। অনুষ্ঠানে উদীচীর জন্ম, জন্মের প্রয়োজনীয়তা, ৫০ বছরের আন্দোলন–সংগ্রাম, ঘাত-প্রতিঘাত ও অর্জন নিয়ে আলোচনা হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই এ আয়োজন নিয়ে নিউইয়র্কে প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে বিরাজ করছে এক বিরাট উৎসাহ-উদ্দীপনা।
উদীচীর জন্ম বা প্রতিষ্ঠা এমন এক সময়, যখন মুক্তির ব্রত নিয়ে নৈরাজ্য আর পরাধীনতার বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে দেশের মানুষ, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সূচনাপর্বে শ্বাসরুদ্ধকর এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসেবে উদীচীর জন্ম। নেতৃত্বে ছিলেন এই উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেতা, প্রগতিশীল সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ, সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী সংগ্রামী সত্যেন সেন। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সহযোদ্ধা ছিলেন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক, সাধক রণেশ দাশগুপ্ত। ছিলেন গোলাম মোহাম্মদ ইদু, মোস্তফা ওয়াহিদ প্রমুখ।
’৬৮ সালে উদীচীর জন্ম হলেও সত্যেন সেন এরূপ একটি সংগঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেক আগেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইংরেজ রাজত্বে বাংলাদেশে মানুষসৃষ্ট এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। পঞ্চাশের সেই মন্বন্তরে খাদ্যাভাব ও অসুখ-বিসুখে বহু লোক মারা যায়। দুর্গত মানুষের সেবায় সত্যেন সেন নানা কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। গান লিখে, গান গেয়ে সচ্ছল পরিবারের মানুষের কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহ করেন। তাঁর লেখা গান তখন জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় পরে তিনি কর্মজীবনের একপর্যায় গড়ে তোলেন একটি গানের দল। তিনি গভীরভাবে আরও উপলব্ধি করেছিলেন, প্রগতিশীল রাজনীতি এগোবে না সংস্কৃতির প্রণোদনা ছাড়া। এ লক্ষ্য নিয়েই সংস্কৃতির শক্তিকে বিকশিত করতে রাজনৈতিক শক্তির পরিপূরক হিসেবে কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন উদীচী।
নিপীড়িত মানুষের গান গাওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল উদীচী। জন্মের পরমুহূর্তেই সমগ্র জাতি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মুখোমুখি হয়। স্বাভাবিকভাবে সদ্য প্রতিষ্ঠিত উদীচীও এক অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয়। হাজারো মুক্তিসংগ্রামীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদীচীর ভাইবোনেরাও যুক্ত হন স্বাধীনতাযুদ্ধে। তাই মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তস্রোতের সঙ্গে উদীচী শিল্পী ভাইবোনের রক্তও একাত্ম হয়ে আছে।
মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানোর বেদনা এবং যুদ্ধের বীভৎস ও তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আবার উদীচী যাত্রা শুরু করে। সংগঠনকে সংগঠিত করার পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, একটি শ্রেণি লুটপাট, আত্মসাৎ ও স্বার্থপরতার ক্ষুধায় বেসামাল হয়ে উঠল। তাদের অপরিণামদর্শী স্বার্থপরতার সুযোগ নিল স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত শত্রু ও এক শ্রেণির ক্ষমতালোভী চক্র। যাকে মধ্যমণি করে সমগ্র জাতি ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখেছিল, স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় জাতির সেই মধ্যমণি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। এত বড় নৃশংস হত্যাকাণ্ডে প্রাণ খুলে জাতি কাঁদতে পারেনি। গুমরে কেঁদেছে। সমগ্র দেশ ও জাতি এক অস্বস্তিকর পরিবেশে পতিত হয়। মুখ ফুটে প্রতিবাদ করার সাহস মানুষ হারিয়ে ফেলেছিল।
সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ভেঙে উদীচীই প্রথম প্রতিবাদের মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী দেশকে পুনরায় পাকিস্তানি ভাবধারায় পরিচালিত করার প্রয়াস পায়। তাই উদীচীর যাত্রা পথ মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বিভিন্ন সময় প্রতিক্রিয়াশীলদের আঘাত এসেছে উদীচীর ওপর। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে বোমা হামলা করা হয়। ১২ জন ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। ১০০ জনের অধিক কর্মী, শুভানুধ্যায়ী গুরুতর আহত হন। তাঁদের বেশির ভাগ জীবনের মতো পঙ্গু হয়ে গেছে। ২০০৫ সালে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ উদীচী অফিসে বোমা হামলা করা হয়। এখানেও দুজন শিল্পী ঘটনাস্থলেই মারা যান। ১৪ বছর পর হলেও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার হয়েছে। দুঃখের বিষয়, উদীচী হত্যাকাণ্ডের বিচার ১৮ বছরেও হলো না। ১০ বছর ধরে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ও বিচার না হওয়ায় উদীচী ক্ষুব্ধ না হয়ে পারে না।
প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের এসব অত্যাচার-নির্যাতন, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সত্যেন সেন ও রণেশ দাশগুপ্তের নীতি–আদর্শ ধারণ ও অনুসরণ করে উদীচী অভীষ্ট লক্ষ্যের পথে যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। উদীচী সংগঠনের যে বীজটি রোপিত হয়েছিল ১৯৬৮ সালে, তার শিকড় আজ অনেক গভীরে বিস্তৃত। শাখা-প্রশাখায় বিকশিত হয়ে উদীচী আজ আকাশ ছোঁয়ার অপেক্ষায়। রণেশ দাশগুপ্তের রচিত গঠনতন্ত্রের নির্দেশিত পথ বেয়ে সাড়ে পাঁচ দশকের ঋদ্ধ উদীচী আজ সারা দেশে ৩৩৫টি শাখায় বিস্তৃত। আমেরিকা, কানাডা, লন্ডন, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বড় বড় শহরে রয়েছে ১৩টির অধিক শাখা। গণমানুষের গান গাওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে, গভীর অন্ধকার থেকে উত্তরণ ঘটানোর লক্ষ্যে যাত্রা শুরু হয়। সংস্কৃতি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে উদীচী যে অবদান রেখেছে তারই স্বীকৃতি রাষ্ট্রের দেওয়া একুশে পদক। সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তসহ অগণিত বিপ্লবী সহকর্মীর আত্মত্যাগের ফসল উদীচীর এই একুশে পদকপ্রাপ্তি।
এ প্রাপ্তিতে আমরা আনন্দিত। এ রকম একটি সংগঠনের কর্মী হতে পেরে আমরা গর্বিত। উদীচী মনে করে এ পদকপ্রাপ্তিতে উদীচীর হাজার হাজার কর্মী বাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তব্য আরও বেড়ে গেছে।
আরেকটি কথা বলতে চাই সেটি হচ্ছে, পাকিস্তানি শোষকদের ২৪ বছরের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম আর শহীদদের আত্মদানের মূল লক্ষ্য ছিল একটি শোষণহীন সমৃদ্ধিশালী সমাজ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ এক গ্লানিকর ও বিপরীত বাস্তবতা আমাদের জীবন ঘিরে রেখেছে। গ্রাস করে চলেছে আমাদের স্বাধীনতার বিভিন্ন অর্জন। বিনষ্ট করছে জীবনের সব সুকুমার দিক। ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং সাম্প্রদায়িকতা ও অপসংস্কৃতির লালিত বিকৃত চিন্তা-চেতনা থেকে মুক্ত হয়ে ব্যক্তি ও সমাজের পরিপূর্ণতা অর্জনের সাধনায় দেশের মানুষ ব্রতী হবে, এটাই ছিল আশাবাদ। পরিতাপের বিষয়, যে দলটি স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছিল, সে দলটিই আজ পরাজিত শত্রুর সঙ্গে নানাভাবে আপস করে চলেছে।
আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে দ্রুত কোটিপতি হওয়ার প্রবণতা ও সুযোগ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ফলে ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। সরকারি কর্মচারী ও আমলাদের বেতন–ভাতা দ্বিগুণেরও বেশি করা হয়েছে। অথচ তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত গরিব মানুষের ভাতার দাবি উঠলে সরকার মালিকদের পক্ষ নিয়ে আটকে রাখে। সরকারি কর্মচারীদের ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৫ শতাংশ, আর যারা পেটের ভাত জোগায় সেই কৃষক ঋণ নিলে তার সুদের হার ১৩ শতাংশ। পদ্মা সেতুর মতো বিরাট অবকাঠামো গড়ে উঠছে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু পাশাপাশি সমাজে মূল্যবোধের অবনতি ঘটে চলেছে।
গণতন্ত্র ও সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক। সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ছাড়া যেমন সুষ্ঠু গণতন্ত্রের বিকাশ হয় না, তেমনি সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ছাড়া সমাজে সুস্থ মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে না। উদীচীর জন্মই হয়েছিল সুস্থ গণমুখী সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে। আজও সে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়নি। বরং লক্ষ্য অর্জনের পথ আরও কঠিন ও কণ্টকাকীর্ণ হয়েছে। তাই বলে উদীচী তার লক্ষ্য থেকে একচুলও পিছপা হয়নি। শাসকদলের রক্তচক্ষু, অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা উপেক্ষা করে এবং দেশের জনগণের আশীর্বাদ পাথেয় করে এগিয়ে চলেছে। ভবিষ্যতেও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে উদীচী তার লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাবে, এই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করতে একটুও দ্বিধা নেই। উদীচীর সুবর্ণ জয়ন্তীতে তাই সংগঠনের ভাইবোনের শপথ
হোক—সত্যেন সেন ও রণেশ দাশগুপ্তের রেখে যাওয়া স্বপ্ন বাস্তবায়ন। উদীচীর আয়োজন সফল ও সার্থক হোক।